নয়

মনোমত স্টাইলের জুতো পাওয়া যাচ্ছে না, কিংবা পাওয়া গেলেও ঠিক সাইজ মিলছে না বলেই খান সাতেক দোকানে ঢুঁ মেরেছে তেজো। এছাড়া আর কিই বা করার আছে কুয়েটে? এক আধটা না, তেরোটা মল যে শহরে সেখানে ধর্মকে কলা দেখিয়ে শপিং-ই যে মানুষের আফিম হয়ে উঠবে তাতে আশ্চর্য কী? শুধু জুতো নয়, আরও অনেক ডাকসাইটে ব্র্যান্ডের নামজাদা দোকানেও ঘোরাফেরা করেছে, কেনাকাটি করবে বলে না, সময় কাটাবে বলে। যেমন র‍্যালফ লোরেন, গুচি, স্যানেল, হারমিস। হাই ফ্যাশানের জামাকাপড়, ভ্যানিটি ব্যাগ, ঘড়ি, আর থরে থরে সাজানো মেক আপের সামগ্রীর সামনে ভাবুক মুখ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে বেশ কিছুক্ষণ। হাসিমুখে এগিয়ে এসেছে সেলসগার্ল, ওর পছন্দের জিনিস বেছে নিতে সাহায্য করবে বলে। পুদিনা পাতার সুগন্ধি চা অফার করেছে। এখুনি কিনলে মোটা ডিসকাউন্টের লোভও দেখিয়েছে। 

            সারাদিনে ছ-কাপ চা খেয়েছে তেজো। দোকান পিছু দশ মিনিট কাটিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা মল-এ। দেখতে দেখতে চোখ পচে গেলে ট্যাক্সি ধরে আল-মুবারাকিয়ার সুক, যেখানে টুরিস্ট আর মধ্যবিত্ত কুয়েটিদেরই ভিড় বেশি। ওকে দেখেই ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছিল সোনার দোকানিরা। খাঁটি চব্বিশ ক্যারেটের হার গলায় পরিয়ে যারপরনাই আদিখ্যেতা। মশলাপাতির গলিতে ঠাসাঠাসি খদ্দের আর দরদস্তুরের গলাবাজি। গন্ধে মম করছে জায়গাটা। তেজোকে কুয়েটি ঠাউরে আরবিতেই বিভিন্ন প্রজাতির খেজুরের মাহাত্ম্য বোঝাতে বসলেন এক দিশদাশা পরা বেদুইন। এদের মধ্যে আতর পাড়ার মালিকদের সঙ্গে গল্প করতেই ওর বেশি ভাল লাগছিল। হাতের তালুতে সেন্টের হাল্কা ছোঁয়া লাগিয়ে মধ্যযুগের ইতিহাস-ভূগোলের চর্চা। আরেবিয়ার আতর মানেই আউদ, অ্যামবর, চন্দন, কস্তূরী, গোলাপ। রামাদানে আউদের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। অতিথি এলে বাখুর মাখে বাড়ির মেয়েরা। “আর গোলাপ?” জিজ্ঞেস করেছিল তেজো। “আরে বাবা, গোলাপ শুধু প্রেমিকের জন্যে, এইটুকু জানো না? তবে যে সে গোলাপ না, সৌদি আরবের তাইফ উপত্যকার বিশিষ্ট দামান্সক।” আর অবশ্যই জুঁইফুল। “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জুঁই কোথায় পাওয়া যায় জানো?” দোকানির প্রশ্নের উত্তরে কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল তেজো, “জানি না।”

            “হিন্দুস্তান।”

            “নো শপিং ম্যাডাম?” হোটেলের রিসেপশানিস্টকে অবাক করে খালি হাতেই ফেরে তেজো। এই লোকটাই ওকে চেক-ইনের সময় জেরা করেছিল। বাঁ হাতের আঙুলে সোনায় বাঁধানো ব্রেজিলিয়ান পান্নার আংটিটা জুলজুল করে দেখছিল। সিংগল না বিবাহিত, প্রশ্ন উঠেছিল তার পরই। ওটা যে বিয়ের আংটি নয়, ফ্যাশন করে পরা, বোঝাতে হয়েছিল তেজোকে। শুধু কুয়েট না, গোটা মিডল ইস্টেই বিয়ে ব্যাপারটা অতীব গুরতর। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীকে  হোটেলে একই কামরায় থাকতে হলে দু’জনকেই হাতে বিয়ের আংটি পরতে হবে। নইলে তাদের সম্পর্ক বিবাহবহির্ভূত বলে ধরা হতে পারে, জরিমানা এবং হাজতবাস দুটোরই সম্ভাবনা প্রবল। ওর বন্ধু জার্নালিস্ট মারিয়া আর তার জাপানি স্বামী হিরো-র বেলায় ম্যারেজ সার্টিফিকেটও দেখাতে হয়েছিল রিয়াদের পাঁচ তারকা হোটেলে। তেজো সিংগল অথচ হাতে আংটি কেন, সেই নিয়ে ধন্দে পড়েছিল হোটেল কর্মচারী। 

            ভুলক্রমেও খাটো স্কার্ট বা হাতকাটা টপ পরা চলবে না। বিকিনির প্রশ্নই উঠছে না, না হোটেলের পুলে বা সমুদ্রে সাঁতার কাটার বেলায়। মদ, মানে বিয়ারও, নিষিদ্ধ। প্রথম দিনই হোটেলে পৌঁছে বস-কে ঝাঁজ দেখিয়েছিল তেজো। 

            “এত দেশ থাকতে কুয়েটে পাঠালেন কেন বলুন তো!” 

            “চাও তো সৌদিতে পাঠিয়ে দিতে পারি। কিং আব্দাল্লা পার্কে মরুভূমির ভেতর কেমন টিউলিপ ফুটিয়েছে দেখে আসতে পারতে!” 

            ঠাট্টা করে পার পাওয়া যাবে না বুঝেও তেজোকে শান্তনা দিতে যান ওর বস, “ভাবো না এটা তোমার ছুটি,” যদিও হিতে বিপরীতই হয় ব্যাপারটা।

            “আমাকে ইরাক থেকে বহিষ্কার করিয়ে কী লাভটা হল আপনার? ভাবলাম কমান্ডার লুকের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নেবেন, আমরা যে মেরিনদের শত্রু নই সেটা বুঝিয়ে টেনশান হাল্কা করতে সাহায্য করবেন। আমাকে বিশ্বাস না করলেও, আপনাকে করবেন কমান্ডার। কিন্তু হলটা কী? ইসরেলের পর ইরাক, বহিষ্কৃত হওয়াই আমার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে! এবার তো সুজিকে দোষ দিতে পারব না, আমারই চ্যানেলের মাথায় আরেক সুজি বসে আছে যে!”

            বস-কে চান্স না দিয়েই একনাগাড়ে বলে চলেছিল তেজো, প্রায় মিনিট পাঁচেক চুপ করে থেকে উনি সব অভিযোগের উত্তর দেন এবার।

            “শোনো, বহিষ্কৃত হওয়া একজন সাংবাকিদের পক্ষে সন্মাঞ্জনক। বিশেষত, নিরপেক্ষতার ধার ধারে না, এমন কেউ যদি তোমার পেছনে লাগে। আর্মি, সে যে দেশেরই হোক না কেন, কখনওই সমালোচনা সহ্য করবে না। কিন্তু আমাদের কাজটা তো আমাদের করতেই হবে।” 

            “আমার কাজটা কার কাজে লাগল?” 

            “লেগেছে তেজো, তুমি এখন এখানে নেই তাই জানো না। প্যাকেজটা দেখানোর পর এদেশে কথাবার্তা চালু হয়ে গেছে। সাদ্দামের পতনের পর আমাদের ইরাকে আর থাকা উচিত কি না, তাই নিয়ে। আমেরিকার বিদেশনীতির সমালোচনা করছেন বেশ কিছু সেনেটার। আজই নিউ ইয়র্ক টাইমস সম্পাদকীয় লিখেছে এ ব্যাপারে, তোমার রিপোর্টের উল্লেখও করেছে। একজন সৎ সাংবাদিকের যা করা উচিত তাই করেছ। তুমি বহিষ্কৃত হয়েছ আমার দায়িত্বে, এতে তোমার প্রফেশনাল ক্ষতি হবে কেন?” 

            “হবে না? এর পর যে কোনও মেরিন কমান্ডার আমাকে সঙ্গে নেবার আগে দশ বার ভাববেন।”

            তেজোকে আবার বোঝান ওর বস। “ভুল ভাবছ। আচ্ছা, ক্রিস্তিয়ান আমানপুরের কথাই ভেবে দেখো না। এই সংবাদ জগতের সম্রাজ্ঞীকেই ইরাকিরা বাগদাদ থেকে বহিষ্কৃত করেনি? তখনও সাদ্দাম বেঁচে ছিল। মস্কো ব্যুরো থেকে প্রায়শই পশ্চিমি রিপোর্টারদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। চীন বা নর্থ কোরিয়া হলে তো কথাই নেই। তাছাড়া আমাদেরও জোর আছে, পেন্টাগনের কর্তারা এক কথায় আমাদের রিপোর্টারকে বাতিল করে দিতে পারবে না।” 

            হোটেলের ঘরে পায়চারি করতে করতে ক্রমশ রাগ পড়ে আসে তেজোর। ওকে বাতিল করবে না মানে কী? আবার আলফা কম্পানিতে ফিরতে পারবে ও? 

            “আসলে কমান্ডার লুক ঠিক তোমার ওপর চটেননি।”

            “না তো কার ওপর?” 

            “অপরিচিত রাস্তা ধরেই সেদিন ফিরছিল আলফা কম্পানি। কিন্তু ভেড়ার পাল দেখে কনভয় থামানোর সিধান্ত উনি নেননি। থামলেও, মেরিনদের ব্র্যাডলি বা ট্যাংক থেকে নেমে বিড়ি ধরাতে পারমিশান দেওয়া হয়নি। দুর্ঘটনা ঘটেছিল ওদেরই অসাবধানতার ফলে। আসলে তোমার রিপোর্টের সঙ্গে একমত হলেও, নিজের ছেলেদের কাছে মুখ রক্ষার খাতিরে তোমাকে সরান লুক।”

            “তাহলে...” ব্যাপারটা ঠিক কী দাঁড়ালো, ভাবতে চেষ্টা করে তেজো। 

            “ব্যাপারটা আর কিছুই না। কিছুটা সময় পাস করিয়ে দেওয়া, এই যা। তারপর আবার যে কে সেই, তোমার রুটিন ফের চালু হয়ে যাবে।” 

            “কুয়েটে সময় পাস মানে কী বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই?” 

            এবার হাসেন ওর বস। “তোমাকে একটা উপদেশ দিচ্ছি। যদি মানো তাহলে সময়টা ঝট করে কেটে যাবে।” 

            “কী উপদেশ? শপিং?” তেজো ঠোঁট ওলটায়। 

            “তার চেয়েও ভাল। হোটেলের রেস্তরাঁয় গিয়ে ‘স্পেশাল চা’ অর্ডার করবে। তাহলেই কেল্লা ফতে!” 

            “স্পেশাল চা ব্যাপারটা কী?” 

            “চায়ের কাপে ওয়াইন, আবার কী!” 

মিডল ইস্টের যুদ্ধ কভার করতে এসে মদের পাশাপাশি হলিউডের ফিল্মও মিস করে অনেকে। আলফা কম্পানি ছেড়ে কুয়েট রওনা হবার আগে নতুন রিলিস করা ছবিগুলোর নাম পইপই করে শিখিয়ে দিয়েছিল জন, নির আর সিএনএনের বাচ্চা রিপোর্টার ব্রুস। “স্টার ওয়ার্সের তৃতীয় এপিসোড দেখতে ভুলো না যেন,” শুনেই ব্রুসকে ধমকে ওঠে ডেভিড। “দুর দুর, হ্যারি পটারই আসল সায়েন্স ফিকশন, আর অ্যাকশন চাইলে ক্লিন্ট ইস্টউড রাজা! কী যেন ওর নতুন ছবির নাম...?” স্বভাবসুলভ মার্কিন বিদ্বেষে মুখ ভেটকে ইউরোপিয়ান ফিল্মের গুন গেয়েছিল জিসেল।

এই এক মজার ব্যাপার। ফেলে আসা জীবনকে মিস করে সব রিপোর্টারই। তাঁবুর হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় কম্বলমুড়ি দিয়ে ম্যাকডোনালডের হ্যামবার্গার আর বিয়ার খাওয়ার স্বপ্ন দেখে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া শক্ত। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে জড়িয়ে সিনেমা দেখা মানে সজ্ঞানে স্বর্গলাভ! শুধু একবার গরম জলে চান করতে পারাটাই সভ্যতার চরম নিদর্শন বলে ধরে নেয় অনেকেই। অথচ বাড়ি ফিরেই মন উড়ুউড়ু। ধুস, এতো যে কে সেই হ্যামবার্গার আর বিয়ার, আসল অ্যাকশনের কাছে ফক্কা। যুদ্ধের মতো জব্বর সিনেমা বানাতে পেরেছে নাকি কেউ!             

আরেবিয়ান ধাও চড়ে ফাইলাকা দ্বীপে বেড়াতে এসে বীচের ওপর পায়চারি করে তেজো, টুরিস্টদের গতিবিধি লক্ষ্য করে মন দিয়ে। মিডল ইস্টের লোকজন বাদ দিলে ইউরোপিয়ান আর ভারতীয়ই সংখ্যায় বেশি। বহু দূর থেকে উড়ে এসেছে প্ল্যাস্টিকের চেয়ারে বসে সূর্যাস্ত দেখবে বলে। সুক-এর সোনা ঘরে নিয়ে যাবে বলে। ওদের দেশে সূর্য নেই? নাকি এই কৃত্রিম পরিবেশই জীবনকে সৌরকরময় করে তোলার পক্ষে আদর্শ। খুব বেশি দূরে নয় কালো ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছে মরুভূমি, ইরাক পুড়ছে, সিরিয়াও। মিসাইলের ধাক্কায় গাজার বস্তির দেওয়াল চুরচুর করে ভেঙে পড়ছে, লেবাননের সমুদ্রতীরে আলিঙ্গনবদ্ধ প্রেমিক-প্রেমিকাদের দেখা যায় না আজ বহুদিন। মুসার কথা ওর মনে পড়ে, ছোট্ট মেয়েটা কি এখনও বাবার সমাধির পাশে ফুল হাতে বসে আছে? মা-কে কাছে না পাওয়ার দুঃখ ভুলিয়ে এক হাতে তিন নাতনির সংসার সামলে চলেছেন আমেরের শাশুড়ি? আজও আল-ফাতসির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন সেই চোরাই বইয়ের মালিক? 

হটাৎ কী ভেবে ঋতাকে ফোন করে বসে তেজো। ওর কলাম্বিয়ার সহপাঠী ঋতা ওরই মতো জেদি, তর্কবাগীশ, ভেড়ার দলে নাম লেখানোর ঘোরতর বিরোধী। বিরোধী বলেই গ্রাজুএশানের পরই ইন্ডিয়া ফিরে যায় ঋতা। একই চ্যানেলে চাকরি পেয়েছিল দু’জনেই, তাই মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল তেজো। ‘তুই বিশ্বজয় কর, আমি বরং দেশউদ্ধার করি’ - কলকাতায় ফিরে জনস্বাস্থ্য-টাস্থ্য নিয়ে এনজিও করাই ওর ইচ্ছে, বলেছিল ঋতা। যাকে বিয়ে করে, মানে অভিজিতও, ওই একই পথের পথিক। তারপর বছর চারেক কেটে গেলেও, এখনও ওদের মধ্যে আগের মতোই টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ। একে ওপরের মানসিক স্থিতি বোঝবার জন্য “হ্যালোই” যথেষ্ট। 

“এখনও লম্বা চুল দেখছি।” ফোন তুলেই বলে ঋতা। 

“তুই আমার চুল দেখলি কোথায়?” 

“কেন, টিভি-তে! এই তো গত সপ্তাহেই দেখলাম বালির টিলার ওপর পোস মেরে লেকচার দিচ্ছিলি। কী যেন নাম জায়গাটার?” 

“ইন্ডিয়ায় বসে আমাদের চ্যানেল দেখছিস?” কারণটা জেনেও প্রশ্ন করে তেজো। 

“বাহ, দেখবো না? তোর ফ্যান বলে কথা! তাছাড়া ঠিকঠাক আছিস কিনা জানতে হবে না?”

“টিভি দেখেই বুঝে যাবি কেমন আছি?”

এক সেকেন্ড চুপ থেকে উত্তর দেয় ঋতা, “খুব একটা ভাল যে নেই সেটা তোর গলা শুনেই বুঝতে পারছি। ভাল থাকলে হটাৎ ইরাক থেকে ফোনই বা করছিস কেন?”

আলফা কম্পানি থেকে বহিষ্কারের ঘটনাটা ঋতাকে গুছিয়ে বলবে ঠিক করেছিল, কিন্তু ক্লান্তি বোধ করে তেজো। কী বলবে ঋতা? ওর বস-এর মতোই প্রবোধবাক্য শোনাবে বড়জোর। ‘তুই নিজের মর্জিমত চলেছিস, এতে আক্ষেপের কী আছে’ - জাতীয় সান্ত্বনা, কিংবা ‘বেঁচে আছিস এটাই যথেষ্ট, এ দেশে থাকলে এতক্ষণে দেশদ্রোহী বলে খতম হয়ে যেতিস।’

“জারনালিসম অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস কোর্সটা তোর মনে আছে?” 

একটু ভাবে ঋতা, “যেটাতে তুই আমার থেকে তিন নম্বর বেশি পেয়েছিলি?”

‘নম্বরের কথা হচ্ছে না। প্যাশন আর প্রফেশানের মধ্যে তফাৎ কী একদিন ওই ক্লাসেই আলোচনা হয়েছিল, তাই না?” নিজের চুলে বিলি কাটতে কাটতে প্রশ্ন করে তেজো।

“প্যাশন ছাড়াই প্রফেশানে উন্নতি করা যায় কিন্তু খালি প্যাশনকে আঁকড়ে বেঁচে থাকতে গেলে সাহসের প্রয়োজন,” প্রফেসার দিমিত্রি দুকাসিসের মতো সুরেলা গলা করে মুখস্ত বলে যায় ঋতা। “এই যেমন আমরা, রোজগারের নামগন্ধ নেই শুধু প্যাশন প্যাশন করে ফতুর হয়ে যাচ্ছি!” তেজোকে হাল্কা খোঁচা মারে ঋতা, “তুই কি ভেবেছিস দুটোকেই বগলদাবা করে চলতে পারবি সারা জীবন? একটা না একটা ছাড়তেই হবে, দেখিস।”

“প্রফেশান নিজের মতো চললে ছাড়তে তো হবেই, তখন তোর মতো আমাকেও এনজিও-ওয়ালি হতে হবে। বুড়ো বাবাকে ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে যেত পারব না হয়তো।” 

“এই তো বেশ পারছিস, আজ ইরাক কাল আফগানিস্থান...” এবার সুর পালটে তেজোকে চেপে ধরে ঋতা, “কী ব্যাপার খুলে বলতো। হটাৎ প্যাশন, প্রফেশান নিয়ে জ্ঞ্যানগম্যি কথাবার্তা! দিমিত্রিকে মিস করছিস নাকি?” 

“করছি না।”

বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র ঋতাই ওর আর দিমিত্রির ব্যাপারটা জানতো। শিক্ষক আর ছাত্রীর মধ্যে প্রেম নতুন কোনও ব্যাপার নয়, কিন্তু এই নিয়ে বহু বিধিনিষেধ চালু থাকে সব আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে। “দিমিত্রি শেষপর্যন্ত ঠিকই পিছিয়ে আসবে,” তেজোকে বলেছিল ঋতা। “তোদের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে ওর চাকরি যেতে পারে। কেউ না কেউ কমপ্লেন করে দিতেই পারে ও তোকে সম্পর্কের বিনিময়ে স্পেশাল ফেভার করছে।” সেদিন ঋতার কথা বিশ্বাস করতে চায়নি তেজো। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সেই ঋতাই ওকে হস্টেলের ঘর থেকে ড্রাঙ্ক অবস্থায় বার করিয়ে আনে, নাইয়ে-খাইয়ে সারা রাত সারা দিন বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফের উঠে দাঁড়াতে সক্ষম করে তুলেছিল। 

বাইরের লোক যে যাই ভাবুক, একমাত্র ঋতাই ওর লৌহকঠিন বর্ম ভেদ করে ঠিক বুঝেছিল ও আসলে কতোটা ভঙ্গুর।  

“তাহলে সেই পুরনো ব্যাপারটা নিয়ে আবার ভাবতে বসেছিস নাকি?” 

“কোন ব্যাপার?”

“যার জন্যে বছর খানেক আগে কলকাতা ঘুরে গেলি। অভি আর আমাকে ঘোড়দৌড় করালি। এত করে বোঝালাম এই নিয়ে মাথা ঘামাস না। অমন মা বাবা পেয়েছিস এটাই তোর পরম ভাগ্য.....”

আরও একটা গোপন কথা জানে ঋতা। শুধু ওর কাছেই তেজো গচ্ছিত রেখেছে জীবনের সেই অজ্ঞ্যাত রহস্য। 

ইরাক থেকে বার দু’য়েক ফোন করেছে, কিন্তু বাবা চিঠির অপেক্ষায় আছেন। নতুন কাজ নিয়ে নিউ ইয়র্ক ছাড়ার আগে বাড়ি গেলে ওর চিঠির ফাইল খুলে দেখান বাবা। কারণটা তেজো বোঝে। আসলে বাবা বলতে চাইছেন, ‘চিঠি লিখতে ভুলিস না। তোর চিঠি পড়লে মনে হয় তুই বেশি দূরে যাসনি, নদীর ওপারে নিউ ইয়র্কেই আছিস। কদিন পরেই ফিরবি, যেমন ক্লাস শেষ করে তোর মা-র রান্না খাবি বলে শনি-রোববার আসতিস।’  

বিদেশে কাজ থাকলে আগের দিন বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া রুটিনে দাঁড়িয়ে গেছে। মা নেই তাই বাবাই দুপুরের রান্না করবেন। ওদের তিনজনের প্রিয় মেনু অনুযায়ীই পালং শাক ভাজা, ডাল আর মাছের ঝোলের সঙ্গে বাগানের টমেটো বা শীতকালে প্লামের চাটনি হবেই। ‘ঠিক মা-র মতো হয়েছে,’ বললে রাগ করবেন বাবা। ‘কী যে বলিস! ওর হাত আর আমার হাত!’ খাওয়া শেষ হলে দু’জনে বাগানে হাঁটবে কিছুক্ষণ, হাঁটতে হাঁটতেই গাছপালা নিয়ে এন্তার খুঁটিনাটি মেয়েকে বোঝাবেন ডঃ রায়। ডাক্তারির পাশাপাশি এটাই ওঁর নেশা। মরশুমি ফুল ফোটানোর ঊর্ধ্বে উঠে দেশবিদেশের নানা জাতীয় গাছ সংগ্রহ। গোটা দুপুর ধরে নতুন নতুন নাম শিখবে তেজো, বিভিন্ন প্রজাতির বনসাইের ভেদাভেদ বা অর্কিড রক্ষণাবেক্ষণের মুল সমস্যা। 

তারপর বারান্দায় চায়ের কাপ নিয়ে বসবে ওরা। নানা প্রসঙ্গ উঠলেও, তেজোর রিপোর্টিং নিয়ে কোনও কথা হবে না। এ ব্যাপারে ওরা দু’জনেই সচেতন। ‘এই কি বাবার সঙ্গে শেষ দেখা?’ বাইপাস হয়ে যাওয়ার পর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছেন বাবা, হাঁসপাতাল থেকে রিটায়ার করার পর ডিমেনশিয়াও ধরা পড়েছে। ইদানীং চেনা লোকজনের নাম ভুলে যাচ্ছেন, মনের মধ্যে জমা কথাগুলো ঠোঁটের ডগা অবধি পৌঁছচ্ছে না। কথার খেই হারিয়ে মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে বসে থাকেন, তেজোর কথা কানে ঢোকে না। পরের বার আবার বাবার হাতে রান্না খেয়ে বাগানে বেড়াবে, নাকি হাঁসপাতালে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে? মনের মধ্যে ঘুরঘুর করলেও, বিষয়টা এড়িয়েই চলে তেজো।

যুদ্ধ থেকে আর ফেরেনি টিভি-তে দেখা এমন সব সাংবাদিকদের ছবি মনের পর্দায় ভিড় করে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে যান ডঃ রায়। মন চাইলেও মেয়েকে বলতে বাধে, “অনেক তো হল, আর ওয়ার রিপোর্টিং নাই বা করলি। পিএইচডি করবি ভেবেছিলি একবার, আরেকবার ভেবে দেখ না!”

সূর্যাস্ত হয়ে গেলে নিউ ইয়র্কে ফেরে তেজো। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে দেখতে পায় বাবা তখনও বারান্দায়। সেই কবে দেশ থেকে আনা মান্ধাতার আমলের ক্যাসেট রেকর্ডারে দেবব্রত বিশ্বাসের গান শুনছেন, গাইছেনও গুনগুন করে.... আজি যত তারা তব আকাশে, সবে মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে...  

            তুমি বলেছিলে, ‘অপেক্ষা করতে শেখ।’ 

বাবাকে লিখতে বসে তেজো।

            ‘যেমন অপেক্ষা করতে হয় মা-কে, সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে।

নিরাময়ের আগে যেমন রুগী শুয়ে থাকে বিছানায়। তোকেও মানতে হবে এই পৃথিবী তাঁর নিজের ইচ্ছার অধীন। তাঁকে সন্মান করলে তবেই  নিজেকে ভাগ্যবান মনে হবে, দুঃখকে অপেক্ষার মন্ত্র বলেই ভাবতে পারবি।’  

            লিখতে লিখতে রাত হয়ে আসে। 

আমি জানি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছো, কাছে নেই বলে তোমার দুঃখ। আর কিসের জন্য অপেক্ষা করে আছো? মা-কে আবার কাছে পাবে বলে? আমার চারিপাশের মানুষগুলোও প্রতীক্ষায় আছে। কবে যুদ্ধ থামবে, কবে আবার নির্বিঘ্নে বাড়ি ফেরা যাবে। মৃত প্রিয়জনের শোক ভুলবে কবে। দুঃখই কি তবে নিরন্তর?

            জানলার বাইরে সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার আওয়াজ। বহুদূরে শঙ্খচিলের ডাক...এত রাতেও ডানা মেলেছে কেন, হন্নে হয়ে বুঝি খুঁজে বেড়াচ্ছে কাউকে? 

তবে অপেক্ষায়ই থাকুক পৃথিবী, যতদিন মানুষের বুকে দুঃখ থাকে। যতদিনে নিস্তেজ হব আমরা সবাই, থাকুক তবে প্রলয়ের শেষ দিন পর্যন্ত। 

            পার্সিয়ান গাল্ফে ডুবসাঁতার কেটে উঠে আসছে সূর্য। বর্ডারের ওপারে মরুভূমির সূর্যই তেজোকে টানছিল। প্রত্যেকটি বালিকণার প্রত্যক্ষদর্শী, জ্বলন্ত লেন্সে ঝলমল করছে ইরাক, এক এক করে জ্বলে উঠছে নাজাফের মসজিদের ভাঙা কাঁচের টুকরো, ভোরের আলোয় ভাসছে শহিদ ইমাম আলির সহযাত্রী শব। দাউদাউ করে পুড়ছে নাসিরিয়া আর কিরকুক। নাবিক সিন্দবাদের বাসরা বন্দরে এখন হিমশীতল মর্গের সৌন্দর্য। বাগদাদের চিড়িয়াখানার বাঘ লুকিয়ে আছে বিধ্বস্ত গুমটিঘরে। ঈদ-উল ফিতরের ভোজ খায়নি মসুলের কেউই, ঘুড়ির বদলে আকাশে উড়েছে শুধুই বোমারু বিমান।

            গোটা রাত জেগেই কাটিয়েছে তেজো। ভোর হয়েছে কুয়েটে, ওর নিউ ইয়র্কে এখনও রাত। ফাঁকা ফ্ল্যাটের বিছানায় ঘুমিয়ে আছে কিম। 

Write a comment ...