আট

“কাল রাত্তিরে কটা ছবি তুলেছিলে? কোথায় সেগুলো?” 

            তেজো আর চার্লিকে নিজের টেন্টে ডেকে নিয়ে জেরা করছিলেন কমান্ডার লুক। সারারাত না ঘুমিয়ে টকটকে লাল চোখ, ঘড়ঘড়ে গলা। এই প্রথম কমান্ডারের মুখে বয়সের ছাপ ফুটে উঠেছে মনে হল।

            “কই, বললে না তো?” 

            প্রশ্ন চার্লিকে, কিন্তু উত্তর দেয় তেজো। “অত রাত্তিরে এত কম আলোয় কী উঠেছে কে বলতে পারে। হয়তো কিছুই পাওয়া যায়নি। অন্য ক্যামেরাম্যানরা...”

            তেজোকে থামিয়ে দেন কমান্ডার, “চার্লি ছাড়া আর কেউই ক্যামেরা বার করেনি। ছবি তোলার প্রশ্নই নেই। কারণটা জানো নিশ্চয়ই?”

            মাথা নিচু করে থাকে চার্লি। কারণটা সবারই জানা। ইরাকে পৌঁছনোর আগেই, সেই দোহার ব্রিফিং-এই পাখিপড়া করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

            “মনে থাকলে, কারণটা একবার বলো দেখি।” চার্লির দিকে ঝুঁকে পড়েন কমান্ডার। পাক্কা মাষ্টারমশাইর মতো চশমার ওপর দিয়ে তাকান। একটা কান বাড়িয়ে দেন ওর দিকে।

            “ঘায়েল মেরিনদের ছবি তোলা যাবে না।” 

            “বাহ, এই তো ঠিক বলেছ। আর যদি বাই চান্স তুলে ফেলো তা হলে কী করতে হবে?” 

            “কমান্ডিং অফিসারের হাতে সেগুলো তুলে দিতে হবে।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য ছাত্রর মতো মুখস্ত বলে যায় চার্লি।

            “গুড! তাহলে ওগুলো দিয়ে দাও এবার।”

            দু’জনকেই চুপ দেখে এবার সুর পালটান কমান্ডার লুক।

            “তোমরা ভাবছ সাংবাদিকের অধিকারে হস্তক্ষেপ করছি, তাই তো? ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে কেউ ঘায়েল হলে, আর্মিই সেই মর্মান্তিক খবর পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেবে। সম্ভব হলে ফোন করে সমবেদনা জানাবেন আমাদের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। এটাই আমাদের রীতি, আমাদের নিয়ম।” একটু দম নেন কমান্ডার, এবার ওঁকে বেশ কঠিন শোনায়। 

            “আর যাই হোক, টিভি দেখতে বসে প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ শুনতে কার ভাল লাগবে? পর্দায় ওই ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখলে বলা যায় না শক থেকে আরেকটা অঘটনও ঘটে যেতে পারে। ঠিক কি না?” 

            “কিন্তু কাল রাত্তিরের ঘটনাকে অ্যাকসিডেন্ট বলা যায় কি?” এতক্ষণে মুখ খোলে তেজো।

            “নয় তো কী?” ভুরু কোঁচকান কমান্ডার। 

            “আমি বলবো, ভুল। মারাত্মক ভুল। যে রাস্তা মেরিনদের পরিচিত নয়, সে রাস্তা ধরে ফেরা হল কেন? এর জবাবদিহি দেবে কে?”

            “কে তোমাকে বলেছে আমরা অচেনা রাস্তা ধরেছিলাম? আর্মির যাতায়াতের রুট তুমি জানবে কী করে?” 

            “আমার গাইড বলেছে। ও এ অঞ্চলেরই লোক। ওখানে যে ল্যান্ড মাইন থাকতে পারে সেটা মেরিনদের জানা উচিত ছিল।”

            “মানে তোমার সোর্স বলেছে, তাই তো?” এবার গলাটা আরও ভারি কমান্ডারের। “ইরাকিদের সঙ্গে কথা বলতে বাধা নেই, তবে যা শুনবে তাই গিলতে হবে এমন তো নয়।” 

            “না হলে কী করব বলুন, আপনি যা বলছেন তাই তো গিলছি সবাই। চেষ্টাচরিত্র করে ইরাকে এসেও ইরাকিদের বাড়ি যাওয়া চলবে না। রাস্তায় বেরনো বারণ। দোকান-বাজার নাগালের বাইরে। ব্র্যাডলি ছাড়া যাতায়াত করা যাবে না, আরব বন্ধু থাকলে সন্দেহের চোখে দেখা হবে, দিনরাত মেরিনদের তোশামোদি করতে হবে। তাহলে স্টোরি করব কী করে বলুন তো? চোখের সামনে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটলেও, আর্মির নিয়ম আর্মিই ভাঙলে, চোখ বুজে থাকতে হবে?” 

            চেয়ার ছেড়ে টেন্টের মধ্যে পায়চারি করেন কমান্ডার লুক। “অ্যাকসিডেন্ট না ভুল অবশ্যই তার হিসেব নেবে মেরিন কোর। আজই এনকোয়াইরি শুরু হয়ে যাবে। তোমাদের কিন্তু কথা দিতে হবে।”

            “কী?” চার্লিকে কিছুটা আশ্বস্ত শোনায়।

            “যতক্ষণ না তদন্তের রিপোর্ট বেরোয়, ছবিগুলো তোমাদের চ্যানেলে দেখানো চলবে না।”

            মুখ চাওয়াচায়ি করে তেজো আর চার্লি। চার্লির ক্যামেরায় ছবি উঠলেও, এ ব্যাপারে রিপোর্টারের সিধান্তই মুখ্য। কথা দিলে দিতে হবে তেজোকেই।

            “আরে এ নিয়ে চিন্তাভাবনার কী আছে?” চার্লির পিঠে হাত বুলিয়ে দেন কমান্ডার লুক। “ইরাকে তো এমন ঘটনা এই প্রথম নয়, গতকাল রাতে ল্যান্ডমাইন ফেটে ক্যাপ্টেন ব্লেয়ার আর ক্যাপ্টেন মার্কের মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক হলেও ইতিমধ্যেই কয়েক-শো মেরিনকে হারিয়েছি আমরা। টাটকা খবর বলে এটাকে চালানো যাবে না।”

“আমার বসের সঙ্গে কথা বলে জানাব,” ভেবেচিন্তে কমান্ডারের প্রশ্নের জবাব দেয় তেজো। 

এবার টেবিলের ওপর ঝুঁকে তেজোকে সরাসরি সম্বোধন করেন কমান্ডার, “বেশ, তাই কোরো। তবে এটা মনে রেখো আর্মির নিয়ম না মানলে আর্মিও সিধান্ত নিতে বাধ্য হবে। তাতে বিশেষ খুশি হবেন না তোমার বস।” 

কিসের হুমকি দিচ্ছেন কমান্ডার লুক বুঝতে ভুল হয় না তেজোর। আর্মির সিধান্ত মানে ওঁর কথা না রাখলে আলফা কম্পানির ক্যাম্প থেকে বিতাড়িত হতে হবে। অচিরেই ইরাকে রিপোর্টিং-এর পালা শেষ হয়ে যাবে। ওর জায়গায় চ্যানেলের পক্ষ থেকে অন্য কাউকে পাঠানো হবে এখানে, আর্মির মন জুগিয়ে চলার মতো শিষ্টাচারি কোনও এক সাংবাদিককে।

টেন্ট ছেড়ে বেরবার আগে তেজোকে ফের একবার মনে করিয়ে দেন ওদের কমান্ডার, “প্রথম দেখে বুঝতে পারিনি তুমি আমাদেরই মেয়ে। দেখো, আন-আমেরিকান কিছু করে বোসো না যেন।”                     

চার্লির বিছানায় বসে লম্বা শাস নেয় তেজো। আল-ফাতসি থেকে ফেরার পর জিরিয়ে নেবার এক সেকেন্ডও ফুসরত পায়নি। দু’জনে মিলে রিপোর্টের প্যাকেজ তৈরি করেছে, বেশিরভাগটাই ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের ঘটনা। অন্ধকারেই অসাধারণ ছবি তুলেছে চার্লি। কনভয়ের আশেপাশে বালির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে মৃতদেহের অংশবিশেষ, সোলজারের হেলমেট, রাইফেল, নাইট গগলস। আহতরা কাতরাচ্ছে। উদ্ভ্রান্তের মতো আকাশে গুলি ছুঁড়ছে মেরিনরা, চিৎকার করে গাল পাড়ছে শত্রুকে। তারই মধ্যে কমান্ডার লুককে হন্তদন্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে। সবার মুখেই একই প্রশ্ন..... “কী হয়েছে? ক-জন ঘায়েল? কনভয় থামাতে কে বলল?” সঙ্গে একরাশ অশ্রাব্য গালাগাল। 

অন্ধকারের মধ্যে চার্লিকে চিনতে পারেনি মেরিনরা, নইলে নির্ঘাত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ব্র্যাডলিতে ফেরত পাঠিয়ে দিত। রিস্ক নিয়েই কাজ করেছে চার্লি, ক্যামেরাম্যানদের যেমন করতে হয়, যদিও এক্ষেত্রে ইরাকিদের চেয়ে মেরিনদের হাতেই বিপদের আশংকা বেশি। ভিডিওর ওপর তেজোর ধারাভাষ্য জুড়ে প্যাকেজ তৈরি করেছে ওরা। আল-ফাতসির উল্লেখ থাকলেও, মূলত একটি বিপর্যয়ের কাহিনী, যুদ্ধক্ষেত্রে অসাবধানতার ভয়ঙ্কর ফলাফল। 

“বিয়ার খাবে তো বলো।” চিন্তার স্রোত থামিয়ে জিজ্ঞেস করে চার্লি।

“এখানে বিয়ার পাবে কোথায়?”

হাসে চার্লি। “মেরিনদের সঙ্গে দোস্তি থাকলে সবই পাওয়া যায়!”

টেন্টের দেওয়াল জুড়ে চার্লির প্রিয় বাস্কেটবল প্লেয়ারদের ছবি। করিম আব্দুল জব্বর, শাকিল ওনিল, ম্যাজিক জনসন, মাইকেল জর্ডান। ওর প্রিয় দল শিকাগো বুলস-এর লাল কালো লোগো। 

“এত ছবি সঙ্গে নিয়ে ঘোরো!” অবাক হয়ে দেখে তেজো। 

ঘাড় নাড়ে চার্লি, “ক্যামেরা যায় যাক, এদের ছাড়া আমি থাকতেই পারব না।”

বোতলে বোতল ছুঁইয়ে “চিয়ার্স!” জানিয়ে, আবার কমান্ডার লুক প্রসঙ্গে ফিরে যায় ওরা। 

“কী ভাবলে? মাইকেল রুবিনকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখলে হয় না? ওঁর মতো অভিজ্ঞ লোক নিশ্চয়ই জানবেন এ অবস্থায় আমাদের কী করা উচিত।” 

চার্লির মতামত মনোযোগ দিয়ে শোনে তেজো। সত্যিই কি মাইকেল পারবেন ওদের সাহায্য করতে? বিচক্ষণ হলেও বড্ড সাবধানী মাইকেল। কমান্ডারের পক্ষেই হয়তো রায় দেবেন। বলবেন, ‘শোনো, ইউনিফর্ম না পরলে কী হবে, আসলে তুমি ওদেরই দলে। ওরাই তোমার রক্ষক। মারা পড়লে কফিনটা দেশে পাঠিয়ে দেবার দায়িত্বও মেরিনদের। কমান্ডারের কথা ফেলবে কী করে বলত?’ 

“এনকোয়াইরি শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করলে ক্ষতি কী? তারপর না হয় প্যাকেজটা পাঠিয়ে দেওয়া যাবে।” 

চার্লি ভয় পাচ্ছে, তেজো বুঝতে পারে। ক্ষমতাবানদের চটাতে প্রেসের সবাই ভয় পায়, অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হবার আগেই বিতাড়িত হতে চায় না কেউই। তার ওপর চ্যানেলের পাকা কর্মচারী নয় চার্লি, ফ্রিলান্সার। দুশ্চিন্তা হবারই কথা।  

“এনকোয়াইরির ফলাফল কী হবে তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে নাকি? ঠিক রাস্তায়ই ফিরছিল আলফা কম্পানি, বালির নীচে কোথায় ল্যান্ডমাইন লুকনো আছে তা ঈশ্বরের পক্ষেও জানা অসম্ভব - এই তো বলবে বিচারকরা।”

“তাহলে কী করবে?”

“প্যাকেজটা পাঠিয়ে দিয়ে বস-কে পুরো ব্যাপারটা খুলে জানাব। উনি যা ভাল বোঝেন করবেন।”

 নিজের টেন্টে ফিরে গামলায় রাখা জলে হাত মুখ ধুয়ে নেয় তেজো। এই মুহূর্তগুলোই একজন সাংবাদিকের জীবনে সবচেয়ে জটিল। যখন নিজেকেই নিজের বিচারক সাজতে হয়। বিচারের মানদণ্ডও একান্ত নিজস্ব হওয়া জরুরি, কারণ রায় ঘোষণার পর আবার নতুন করে আপিল করার অবস্থা থাকে না। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুমে শেখা কথাগুলো মনে পড়ে যায়। শিখিয়েছিলেন যিনি, তাঁকেও। 

“কেন জার্নালিস্ট হতে চাও, আগে নিজেকে সেই প্রশ্ন করো। একটা নির্ভরযোগ্য প্রফেশান চাও বলে? নাকি তার চেয়েও বড় কিছু?” 

দাড়ি আর পনি-টেল সমেত যিশু খ্রিস্টর মতো চেহারা প্রফেসার দিমিত্রি দুকাকিসের প্রেমে পড়েছিল ক্লাসের সবাই, তেজোও। আর পাঁচজন শিক্ষকের মতো নয়, গান-কবিতা-গল্প শুনিয়ে ছাত্রদের মোহিত করে ফেলেছিলেন দিমিত্রি। ওঁর লেকচারে যাওয়া মানে পুরনো ধ্যানধারণা বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীটাকে নতুন করে চেনা। 

“তথ্য না মতামত - কোনটা বড় বলো দেখি?”

যারা তথ্যের পক্ষে হাত তুলেছিল তাদের প্রশ্ন করেছিলেন, “তোমার মনস্তত্ত্ব আর দৃষ্টিভঙ্গিই ঠিক করে দেবে কোন তথ্য জরুরি কোনটা নয়। যদি মনে করো আমেরিকায় রেসিসম নেই তাহলে এখানকার জেলে কালো মানুষের সংখ্যা এত বেশি কেন তা নিয়ে স্টোরি বানাতে চাইবে কি? এ বিশ্বব্রম্ভাণ্ডে খাঁটি বলে কিছুই নেই, তথ্যের গায়ে মতামতের ছোঁয়াচ লাগবেই।”

যারা মতামতের পক্ষে হাত তুলেছিল, তাদেরও কোণঠাসা করতে ছাড়েননি।

“তাহলে নিজের মতামত নিয়ে বাড়ি বসে থাকলেই হয়, ঘাম ঝরিয়ে তথ্য সংগ্রহের দরকার কী? সেভাবে ভাবতে গেলে যে কেউ আরাম কেদারায় গা এলিয়ে সাংবাদিক বনে যেতে পারে।” 

“কোনটাই একে ওপরের চেয়ে বড় নয়,” সেদিন প্রফেসারের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল তেজো। “খবরের জন্ম তথ্য আর মতামতের সন্ধিস্থলে।” 

“ঠিক উত্তর!” যিশু খ্রিস্টের মতোই অনাবিল হাসি হেসেছিলেন দিমিত্রি।

মতামতের গুরুতর ছোঁয়াচ লেগেছে বলেই বোধহয় ইরাকে এসে খুঁজেপেতে তথ্য যোগাড় করার তাগিদ অনুভব করছে না তেজো। কী সাদ্দামপন্থি কী আমেরিকা, কেউই ইরাকিদের ভাল চায় না, দেশটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। ন্যায়-অন্যায়ের বিচারে এগিয়ে আছে এমন দাবি করতে পারবে না বিবদমান কোনও গোষ্ঠীই। রিপোর্ট পেশ করতে এমন ক্লান্তি আগে ও বোধ করেনি কখনও। 

“কেবলমাত্র খবরের সঙ্গে একাত্ম হওয়া সম্ভব কি?” দিমিত্রিকে একবার প্রশ্ন করেছিল ক্লাস শেষ হবার পর। ততদিনে ওরা একে ওপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ক্লাস কেটে দিমিত্রির অফিসেই পড়ে থাকে সারাদিন। লেখাপড়ার বাইরেও নানান বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা। প্রফেসার না, বন্ধু বলেই ওর সঙ্গে অনেক কিছুই শেয়ার করত তেজো - পারিবারিক জীবনের খুঁটিনাটি, ব্যাক্তিগত অনুভূতিও। দিমিত্রির টেবিলে রাখা ওর স্ত্রী এলিনার ছবি দেখে অকারণেই খুঁচিয়েছিল একবার, “ওকে তুমি সত্যি ভালবাসো, না অফিসে পার্টনারের ছবি রাখতে হয় বলে রেখেছ?” কেন ওর ছেলেমানুষি, ওর পাগলামিকে প্রশ্রয় দিয়েছিল দিমিত্রি? ও ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী, তাই? নাকি গভীর কোনও সংযোগের অপেক্ষায় ছিল বলে?

“জার্নালিস্ট না হয়ে প্রফেসার হতে গেলে কেন বলত?”

প্রিয় প্রফেসারকে প্রশ্ন করেছিল তেজো ওর গ্র্যাজুএশানের দিন, শেষবারের মতো যখন ওরা ঘনিষ্ঠ হয়েছিল দিমিত্রির অফিসে। চুপ করে গিয়েছিল দিমিত্রি, তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, “কারণ নিজেকে বিচার করার মতো সাহস আমার নেই।” 

রিপোর্টের প্যাকেজ পাঠিয়ে দিয়ে স্যাটেলাইট ফোন নাড়াচাড়া করে তেজো। তারপর অল্প কথায় বস-কে মেসেজ করে জানিয়ে দেয়.......“যা দেখেছি, তাই পাঠালাম। যা ভাল বোঝেন, তাই করবেন।” 

✪✪✪

 “আমাদের সব্বাইকে টপকে সবচেয়ে আগে ছুটি পেয়ে গেলে কী করে বলত?” ব্রেকফাস্টের আগেই তেজোকে পাকড়াও করে সুজি। “কমান্ডারকে পটালে কীভাবে ভালোয় ভালোয় বলে ফেলো তো।”

            “ছুটি! কার ছুটি? কী ভুলভাল বকছ!” 

            “ওসব ন্যাকামি ছাড়ো। মরুভূমির গরমে পচে মরব আমরা, আর উনি যাবেন কুয়েটে আয়েশ করতে!” তেজোর আপত্তি উড়িয়ে নিজের দুঃখের ঝুলি উজাড় করে দেয় সুজি। 

            “ভেবেছিলাম মিডল ইস্ট থেকে রক্ষা পাবো এবার। থাইল্যান্ড বা ইন্ডিয়া পাঠাবে আমার চ্যানেল। কেন, ওখানে কী ঝামেলা নেই? যত মারামারি কাটাকাটি, যত খবর শুধু এই পোড়া মরুভূমিতে? সব কিছু গুবলেট করে দিল তোমাদের চ্যানেল। ইরাক ইরাক করে খামোখা হাওয়া গরম করলে তোমরা। আমার বস-ও পিছিয়ে থাকবে কেন? মাঝ থেকে ঝুলে গেলাম আমি।”

            শুধু সুজি না, বাকিরাও অভিনন্দন জানাতে ভিড় করেছিল রিপোর্টারর্স মেসে। জিসেলের উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। তেজোর লম্বা চুলে হাত বুলিয়ে ঠাট্টা করছিল। 

            “তোমার মতো সুন্দরী মিছিমিছি এখানে পড়ে আছো কেন? চান্স পেয়েছ, কেটে পড়ো! নইলে যদ্দিনে যুদ্ধ শেষ হবে তদ্দিনে সব হ্যান্ডসম ছেলেদের বিয়ে হয়ে যাবে!” 

            মাইকেলও পেছনে লাগতে ছাড়ছিলেন না। “আরে বাবা, বিয়ে করবে কেন? এখন ওর অ্যাফেয়ার করার বয়েস। যুদ্ধ আর প্রেম - এর থেকে বেটার কম্বিনেশান হয় নাকি!” 

            “হক কথা,” নিজের ভুল শুধরে নেয় জিসেল। “যাও, একটা ফ্রেঞ্চ প্রেমিক জুটিয়ে চুটিয়ে প্রেম করে এসো!” 

            “ফ্রেঞ্চ কেন?” লা পাইসের মানুএল ভুরু কোঁচকায়।

            “কারণটা জানো না?” মুচকি হাসে জিসেল। “কারণ স্বর্গে ফরাসিরাই প্রেমিক, ব্রিটিশরা পুলিশ, জার্মানরা মেক্যানিক, ইটালিয়ানরা রাঁধুনি আর সুইসরা ম্যানেজার।” 

            “আর নরকে?” সদ্য ঘুম ভেঙে হাই তোলে নির।

            “নরকে সুইসরা প্রেমিক, জার্মানরা পুলিশ, ফ্রেঞ্চরা মেক্যানিক, ইটালিয়ানরা ম্যানেজার আর ব্রিটিশরা রাঁধুনি!”

            “স্প্যানিশরা কী দোষ করল?” নাছোড়বান্দা মানুএল জিসেলকে চেপে ধরে, “ডন হুয়ানের নাম শোনোনি? ওর চেয়ে ভাল প্রেমিক কস্মিনকালে দেখেছে কেউ?”

            “আর আমেরিকানরা কী হবে?” এতক্ষণ চুপ থেকে জন এবার মুখ খোলে। 

            “আমেরিকান মানেই সেইরকম ফুটবলার যারা সেম-সাইড গোল দিতে সিদ্ধহস্ত!” জিসেলের উত্তরে চুপ করে যায় সবাই।

            তেজোকে চোখ টিপে ডেকে নেয় ডেভিড, মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে, “ব্রিটিশদের বদনামে কান দিও না একদম। এখন আর আমরা মোটেই খারাপ রাঁধুনি নই। ইন্ডিয়ানরা আমাদের কারি রান্না শিখিয়ে দিয়েছে। কুয়েটি খানাও মন্দ নয়, ওদের মাকবুস চেখে দেখতে পারো। সুগন্ধি চালের মধ্যে মাটন বা চিকেন, অনেকটা বিরিয়ানির মতোই।”

            মেস ফাঁকা হলে চার্লি ওর ডান হাত চেপে ধরে, “সরি, তেজো!” 

            “সরি, কেন?” 

            “দোষ করলাম আমরা দু’জনে, কিন্তু শাস্তি পেলে খালি তুমি।” 

            “তুমি বলছ শাস্তি, ওরা বলছে ছুটি। কী ব্যাপার বলো তো?”

            একবারটি চারিদিক দেখে নেয় চার্লি, তারপর নিচু গলায় গড়গড় করে বলে, “আমাদের বস গতকাল রাত্তিরেই আমাদের প্যাকেজটা দেখিয়ে দিয়েছেন। এখানে তখন কাক ভোর। পেন্টাগন থেকে খবর পেয়ে যান কমান্ডার লুক। মেরিনরা খেপে যাবে ব্যাপারটা জানলে। ওদের দু’জনের মৃত্যুর জন্যে ওদেরই যে দায়ী করা হচ্ছে সেটা কিছুতেই মানতে চাইবে না। ক্যাম্পে সোলজার আর রিপোর্টারদের মধ্যে ঝামেলা লেগে যেতেই পারে, তাই আগেভাগে তোমাকে সরিয়ে দেওয়ার সিধান্ত নিয়েছেন কমান্ডার।” 

            “আমাকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে?” 

            “কিছুদিনের জন্যে। বলা হচ্ছে ব্যাক্তিগত কারণে তুমি আপাতত ইরাক ছাড়ছো, তবে ফিরে আসবে শিগগিরি।” আবার কাঁচুমাচু মুখ করে চার্লি। “আমার জন্যেই গোলমালটা হল, আগ বাড়িয়ে ছবি না তুললে...”

            ওকে থামিয়ে দেয় তেজো। “তুমি ছবি না তুললে, যুদ্ধের আসল খবরটাই মিস করে যেতাম। বাকিদের মতো জোলো রিপোর্ট পাঠাতে হত। তাতে কার কী লাভ?”  

            “আমের খুব দুঃখ পেয়েছে খবরটা পেয়ে। তোমার আর ওর মধ্যে বেশ সুন্দর বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। ওর ভাষায়, তুমি শুধুমাত্র জার্নালিস্ট অর্থাৎ ভাগাড়ের শকুন নও, তোমার মধ্যে ও দরদী একজন মানুষকে দেখতে পেয়েছে।”

            বাধ্যতামূলক ছুটিতে গেলে আমেরকে হয়তো হারাবে ওরা, রোজগারের তাগিদে অন্য কোন “স্যারের” গাইড হতে হবে ওকে। নইলে তিন মেয়ে আর শাশুড়ির সংসার টানবে কী করে? যদি না ওদের বস-কে বলে কয়ে ওর জন্যে খরপোশের ব্যাবস্থা করা যায়। চার্লিকে বলতেই হইহই করে ওঠে, “তাহলে দারুণ হবে! একবার ওকে হারালে কেউ ওকে ছাড়তে চাইবে না। যতদিন না ফেরো, বরং আমার সঙ্গেই ঘুরুক ও।” 

            নিজের জন্য আনা র‍্যাসন চার্লিকে দিয়ে দেয় তেজো। গুঁড়ো দুধ, মাঝরাত্তিরের ক্ষুন্নিবৃত্তি কিটক্যাট চকোলেট, চিজ, দোহা থেকে কেনা খেজুর, সুপের প্যাকেট, কফি, মশার স্প্রে, বাড়তি ব্যাটারি, এক বাক্স কাপড় কাচার সাবান। কিছুক্ষণ ধরে ক্যাম্পের ওপর চক্কর কাটছিল যে হেলিকপ্টার সেটা এবার ওরই টেন্টের সামনে নেমে এলো। এটাই ওকে নিয়ে যাবে কুয়েটে। ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে আসে তেজো। পিঠে টোকা মেরে থামায় আমের। 

            “এক মিনিট, স্যার।” তারপর জিব কাটে, “সরি!”

            তেজোকে দেবে বলে হাতে করে কী একটা নিয়ে এসেছে আমের। প্ল্যাস্টিকের বাক্সর মধ্যে সবুজ রঙের দোলমা, ওর শাশুড়ির বানানো। লাজুক হাসে আমের। আঙুর গাছের পাতায় জড়ানো শুকনো ভাত আর অলিভের তেলে জারানো ছিটেফোঁটা আনাজ। যুদ্ধের বাজারে এটাই দুর্লভ, অতিথি আপ্যায়নের সামান্য উপায়।           

            বালির ঝড় তুলে ক্যাম্প ছেড়ে ওপরে ওঠে হেলিকপ্টার। মরুভূমির বুকে স্থাণু ক্যারাভ্যানের মতো ক্রমশ ছোট হয়ে যায় কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা তাঁবুগুলো। ভেতরে বিউগলের বেসুরো চিৎকার, আর তাল মিলিয়ে পিঁপড়ের সারি মেরিনদের কুচকাওয়াজ। হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে আমেরিকা আর স্বাধীন ইরাকের ফ্ল্যাগ। চোখ ধাঁধাচ্ছে স্যাটেলাইট ডিশ। তারই মধ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ওর দিকে হাত নাড়ছে দুই বেদুইন - জিমি হেনড্রিক্স আর তার বন্ধু আমের। 

            বুকের মধ্যে কষ্ট হয় তেজোর।  

Write a comment ...