দুই

২০০৬-এর তিরিশে ডিসেম্বর ভোর ছ’টায় মনুষ্যজাতির বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় সাদ্দাম হুসেনকে। পবিত্র ঈদ আল-আধার প্রথম আজান তখন সবেমাত্র থেমেছে। ঘুম ভাঙিয়ে তাঁকে খেতে দেওয়া হয়েছিল মুরগির মাংস আর ভাত। সঙ্গে ঈষৎউষ্ণ মধু। কোরান হাতে আবৃত্তি করছিলেন ইসলামের প্রথম শাহাদাত... লা ইলাহা ইল্লা লাহ, যখন দড়িটা তাঁর গলায় পরিয়ে দেওয়া হয়। “এবার জাহান্নামে যাও!” চেঁচিয়ে উঠেছিল কেউ একজন। “আল্লাহ-র জাহান্নাম তোমাদের ইরাকের জাহান্নামের চেয়ে শতগুণ কাম্য,” আবৃত্তি থামিয়ে উত্তর দেন সাদ্দাম। পুরো ঘটনাটা নিজের মোবাইল ফোনে ধরে রেখেছিল এক সান্ত্রি, পরে যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে নাকি মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বুশ, মৃত্যুদণ্ড-কে পরিহাসে পরিণত করার জন্য। অন্তিম মুহূর্তে শত্রুকে লাঞ্ছনা না করে সন্মান জানানোই সভ্যতার নিদর্শন।

            ঘুম চোখে ব্রিফিং-এর পাতা ওলটায় তেজো। আসল কাজ শুরু করার আগে এটাই ওর কাজ। অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে শিক্ষিত করে তোলা। ঘটনাস্থলে পৌঁছোবার আগেই ওকে গোটা পরিস্থিতি বুঝে নিতে হবে - ইতিহাস, ভুগল, সংস্কৃতি, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, ধর্ম; মুখ্য ভূমিকা পালন করছে যারা, কী তাদের প্রকৃত স্বরূপ; কারা জিতছে, কাদের পক্ষে জনমত, কোন প্রশ্নে সরকার ভাঙবে, কোথায় গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে এমন সব তথ্য যা অন্য চ্যানেলের রিপোর্টারদের নাগালের বাইরে। এর জন্যই ব্রিফিং। হাত-পা নেড়ে প্রশ্ন করবে তেজো, আর খেই ধরিয়ে দেবে সংবাদ সংস্থার এক দল পোষা গবেষক, যাদের কাজই হল গোটা পৃথিবীটাকে গুলে খাওয়া। কারণ খবরের দর্শক এক আজব প্রাণী। শুধু খবর খেয়ে তার মন ভরে না, খবরের মানেও বুঝিয়ে দিতে হয়, মাইক হাতে শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় বেচারি সাংবাদিককে। 

            মাঝ-আতলান্তিকে আর এক কাপ কফি চেয়ে নেয় তেজো। ইরাক মানেই মহাভারত! গত দশ বছরে যা কিছু ঘটেছে ওই দেশটায়, গোটা আমেরিকায় তার সিকির সিকিও ঘটেনি। ইরাক বর্জিত খবর ইদানীং কালে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। প্লেনের ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে ওই ব্রিফিং-ই যথেষ্ট, যার কল্যাণে মাত্র বারো ঘণ্টায় ওর মগজে ঢুকে যাবে এমন সব ধ্যান ধারনা, তাবড় রাজা-উজিরকে প্রশ্নবাণে বধ করার পক্ষে আদর্শ।

            কফিই রিপোর্টারের বন্ধু। ঘুমোলে ঘুমোক প্লেনের সব্বাই, ছুটি নেই শুধু বিমান সেবিকা আর তেজোর।

            ফাঁশিকাঠ থেকে তিকৃত, যে গ্রামে জন্ম সেখানেই কবরে গেলেন সাদ্দাম। তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে। মাত্র একুশ দিনের যুদ্ধে বাগদাদ পতনের পরও সাদ্দাম অনুগতদের দৌরাত্তি থামেনি। এখন ইরাকে মাসে সত্তর-খানেক সুইসাইড বোমা, গড়ে এক হাজার মৃত্যু, যার মধ্যে সাধারণ নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। ঘর ছাড়া প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষের আশ্রয় রিফিউজি ক্যাম্পে। এমনিতেই জনসংখ্যার তিরিশ ভাগ দারিদ্রসীমার নীচে। ষাট শতাংশ বেকার। দেশ ছেড়ে পালাতে ব্যস্ত ইরাকিরা হয় টার্কির বর্ডারে খোলা আকাশের তলায় ধুঁকছে, কিংবা বাঁধ ভেঙে ভূমধ্য সাগরে ভেলা ভাসিয়েছে ইউরোপের উদ্দেশে। ধ্বংস হয়ে গেছে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ভাস্কর্য, মধ্যযুগের মসজিদ, মিউসিয়ামের তালা ভেঙে লুট হয়ে গেছে জাতীয় সম্পদ। এলোপাথাড়ি বোমাবর্ষণে গোটা নিমরুদ শহরটাকেই নিশ্চিহ্ন। রাজধানী বাগদাদে অফিস দোকানপাট বন্ধ, বন্ধ স্কুল, ধু-ধু খামার, নিরাপত্তাবেষ্টনীর ঘেরাটোপে বন্দি শাসক ও সরকার। 

            নিমরুদ নামটা ওর পরিচিত। নিউ ইয়র্কের মিউসিয়ামে দেখা পাথরের স্ট্যাচু তেজোর মনে পড়ে যায়। নিমরুদের ধাত্রীদেবতা প্রকাণ্ড সিংহ, যার মাথায় মানুষের মুখ, কাঁধে ঈগলের ডানা। নিমরুদের কাছাকাছি পৌঁছতে হবে ওকে, মসুলের তিরিশ মাইল দক্ষিণে। ওটাই প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র, ইরাকের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে ওখানেই - অন্তত গবেষকরা তাই মনে করছে। 

            সংখ্যালঘু শিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই সংখ্যাগুরু সুন্নির। এরই মধ্যে উভয়পক্ষের সঙ্গে শত্রুতা চালিয়ে যাচ্ছে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিদার উত্তরের কুর্দ বাহিনী। ঐক্যবদ্ধ নয় কেউই, তলিয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যাবে। শিয়া সরকারের তোয়াক্কা করে না শিয়া ধর্মগুরু, সুন্নি নেতাদের কসম খেতে রাজি নয় সুন্নি জমিদারের দল। এই জটিল অঙ্কে নাক গলিয়েছে মৌলবাদি ইসলামিক আল কায়িদা, লেবাননের জঙ্গি হেজবল্লাহ, আর পাঁচমিশেলি জেহাদিরা। এদের টানেই মরুভূমির জমি আর তেলের খনি দখলের লড়াইয়ে সামিল হয়েছে আমেরিকা-ইউরোপ, রাশিয়া, টার্কি, ইরান - যার ফলাফল এক বিচিত্র সংঘাত, ব্রিফিং-এর ভাষায় “দ্য মোস্ট কমপ্লেক্স ওয়ার ইন হিউম্যান হিস্ট্রি।”

            যুদ্ধের আগে লন্ডন, প্যারিস বা বেরুটে প্লেন পালটে সরাসরি বাগদাদে পৌছনো যেত। এখন ঘুরপথে যেতে হবে তেজোকে। প্রথমে কাতারের রাজধানী দোহা। তারপর গাড়িতে ঘণ্টা খানেকের পথ। আল উদেইদের মার্কিন সেনা ঘাঁটিতেই জড়ো হতে হবে সাংবাদিকদের। আরেক দফা ব্রিফিং-এর পর হেলিকপ্টার মারফৎ ওদের পাঠানো হবে ইরাকে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে এটাই এখন নিয়ম। খবর চাও তো সেনাবাহিনীর শরণাপন্ন হও, ওরাই যাবতীয় ব্যাবস্থা করে দেবে, নিরাপত্তার দায়িত্বও ওদেরই। সামান্য মূল্যের বিনিময়ে সিনেমা হলের মতো প্রথম সারিতে বসে যুদ্ধের দৃশ্য দেখা যাবে। প্রয়োজনে যত ইচ্ছে কমান্ডোদের ইন্টার্ভিউ নাও, শরণার্থীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে মানবিক স্টোরি বানাও, বিধ্বস্ত শহরের রাস্তায় ক্যামেরা চালাও - দায়িত্বশীল আর্মি কমান্ডার ট্র্যাভেল এজেন্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বইতরিনি পার করাবেন সাংবাদিক কুলকে। 

            সংবাদ সংস্থার বসদের মনঃপুত এহেন ব্যাবস্থা, বিনিময়ে মূল্য অতি সামান্য। সেনাবাহিনীর খাতায় নাম লেখাতে হলে আগেভাগে সাংবাদিকের ঠিকুজি-কুষ্ঠি পাঠিয়ে দিতে হবে, যাতে তার নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে নেওয়া যায়। সে কি যুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে? শত্রুর প্রতি কোনও রকম দুর্বলতা আছে কি না, গোপনীয় খবরাখবর চালান করার সম্ভাবনা কতটুকু, ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু পরীক্ষায় পাস করলেই হবে না, একাধিক সর্ত মেনে চলবার গ্যারান্টি দিতে হবে। যেমন, এক) যুদ্ধের আগাম প্ল্যান কোনমতেই ফাঁশ করা চলবে না, দুই) নিজের খেয়ালখুশি মতো ক্যাম্প ছেড়ে বেরনো যাবে না, তিন) বন্দুক বা নিজস্ব কোনও অস্ত্র রাখা বেআইনি, চার) হেলমেট আর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছাড়া রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরির প্রশ্নই নেই, সৈনিকের মতোই সাজসজ্জা করতে হবে সাংবাদিককে, সর্বদা সঙ্গে রাখা চাই স্যাটেলাইট ফোন, পাঁচ) কমান্ডারের কথার ওপর কথা বলা চলবে না।

            এক থেকে চার মেনে নিতে পারলেও, পাঁচ নম্বরে আপত্তি তুলেছিল তেজো। যুদ্ধের কোনও খবরই সেনাবাহিনীর অনুমতি ছাড়া ইরাকের বাইরে পাঠানো নিষেধ। দিনের শেষে ট্র্যাভেল এজেন্টের পোশাক ছেড়ে হেডমাস্টারের ছড়ি হাতে নেবেন কমান্ডার, দর্শকের কাছে পৌঁছোবার আগে রিপোর্টের খসড়া তাঁর হাত দিয়ে পাশ করিয়ে নেওয়া চাই। 

            “মানে সেন্সরশিপ?” ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেছিল তেজো। বসের পছন্দ হলেও, তেজোর পছন্দ নয় এই ব্যাবস্থা।

            “হ্যাঁ, তাই।” ওর দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিয়েছিলেন বস। 

            “তাহলে আর সাংবাদিকতার মানে কী? কমান্ডারই স্টোরি লিখুক। আর্টিকাল নাইনটিনেরই বা কী প্রয়োজন? রাইট টু ইনফরমেশান নেই মানুষের? সত্যি ঘটনা জানবার অধিকার থাকবে না? খবরের নামে প্রপাগ্যানডা গিলতে হবে?”

            “ওসব আর্টিকাল নাইনটিন-ফাইনটিন ছাড়ো!” মৃদু ধমক দিয়েছিলেন বস, তারপর সুর নরম করে বুঝিয়েছিলেন তেজোকে।

            “এটা যে-সে যুদ্ধ নয়। ২০০৩ থেকে আজ অবধি ইরাকে কতজন রিপোর্টার মরেছে জানো? একশো তিরাশি জন। সিরিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তানের চেয়েও ঢের বেশি। অপহরণ, ধর্ষণ, কিডন্যাপের সংখ্যা যোগ করলে এক হাজার ছাড়িয়ে যাবে। একজন সোলজারের চেয়ে একজন রিপোর্টারের মরার চান্স শতকরা দশ গুন বেশি। সত্যের হিসেবনিকেশ না তোমার জীবনের দাম, কোনটা নিয়ে মাথা ঘামাব বলো দেখি? সর্তগুলো না মানলে খবরের ব্যাবসা ছেড়ে কফিনের ব্যাবসায় নামতে হবে, বুঝলে?” 

            “কিন্তু আমার প্রফেশান যা বলে...” 

            এবার ওকে থামিয়ে দেন বস, “মনে রেখো রিপোর্টারের মতো সৈনিকেরও একটা প্রফেশান আছে। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখাই যার একমাত্র দায়।” 

            কফির বদলে স্যান্ডউইচ নিয়ে আসে বিমানসেবিকা। নিউ ইয়র্ক ছাড়ার পর পেটে খাবার পড়েনি এতটুকু, মনে করিয়ে দিয়ে যায়। ব্রিফিং থেকে মুখ তোলে তেজো। বাবার কথা মনে হয়। “খেয়েছিস?” দেখা হলেই ঠিক জিজ্ঞেস করবেন। ফোন করলেও তাই। মা চলে যাওয়ার পর বাবাই ওর নিকটতম আত্মীয়, সংবাদ সংস্থার খাতায় নেক্সট-অফ-কিন জগদীশ রায়ের নামই দেওয়া আছে, অঘটন কিছু ঘটলে যে ব্যাক্তিকে জানাতে হবে অবশ্যই। প্লেন ধরার তাড়ায় বাবাকে জানিয়ে আসা হয়নি - মনে মনে নিজেকে বকে তেজো।    

পরের পরিচ্ছেদ

আগের পরিচ্ছেদ

সূচিপত্র

Write a comment ...