পাঁচ

প্রথম রাতে ঘুম আসতে চায় না। শরীর এবং মন দুই-ই সতর্ক, বড় বেশি সজাগ। বলা যায়, এটাই ওর রুটিন। অপরিচিত পরিবেশে যে কোনও সংকেতই ওর কাছে অর্থবহ। টেন্টের ক্যানভাস ঢাকনির ওপর হাওয়ার ঝাপট মনে করিয়ে দেয় এটা যুদ্ধক্ষেত্র, নিউ ইয়র্কের ফ্ল্যাট ছেড়ে অনেক দূর এসে পড়েছে তেজো। আলো চাইলে সম্বল টর্চ, মেঝে বলতে বালির ওপর প্ল্যাস্টিকের আস্তরণ। শোবার আগে হাতের কাছে সব কিছু রাখা চাই, পায়ের বুট থেকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, যাতে মাঝরাতে সাইরেন বাজলে এক নিমেষে বেরিয়ে পড়া যায়। শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাবার জরুরি পদক্ষেপগুলো ঝালিয়ে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। 

            ঘুম না এলে, মনে মনে কিমের সঙ্গে কথা বলে তেজো। দু’জনেই নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা, কিন্তু কথোপকথন বাংলায়ই। সারাদিন নিজের ধান্দায় ঘোরারাঘুরি করলেও, রাতে ওদের বাক্যবিনিময় হবেই। ‘এদিকে আয়, কিম...খেয়েছিস ভাল করে?’ নিঃশব্দে বিছানায় উঠে আসবে কিম, নিজের ভাষায় তেজোকে দিনের রিপোর্ট পেশ করবে। লেজটাকে বিনুনির মতো হাতের তালুতে জড়িয়ে যাবতীয় গোপন অনুভূতি শেয়ার করবে তেজো, অফিসে কে ওকে অযথা খোঁটা দিয়েছে, কার ব্যবহারে ও দুঃখ পেয়েছে, আসবে বলেও আসেনি কোন বন্ধু, এইসব। মুখ গম্ভীর করে শুনবে কিম, তারপর বিচক্ষণ ব্যাক্তির মতো নিঃশব্দে সান্ত্বনা দেবে। মা-র কথা মনে পড়লে তেজোর চোখে জল আসবে, আর অন্ধকারের মধ্যেই ওর গালে থাবা বুলিয়ে দেবে কিম।

            “ঘুমের মধ্যে কার সঙ্গে কথা বলছিলে?” চার্লি জিজ্ঞেস করেছিল একবার। তখন ওরা জালালাবাদে সেনাদের খোঁড়া ট্রেঞ্চের মধ্যে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। লজ্জায় উত্তর দেয়নি তেজো।

            “সে যেই হোক, বড় সুন্দর তোমাদের ভাষা।” তারপর থেকেই ওর পেছনে লাগত চার্লি, ঘুমের মধ্যে প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমালাপ চালিয়ে যাবার জন্য। 

            অনেক চেষ্টা করেও ঘুম না এলে, মনে মনে বাবাকে চিঠি লেখে তেজো। মেয়ের কাছ থেকে ফোন আর হাতে লেখা চিঠি পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক, বুঝিয়েছিলেন ডঃ অরবিন্দ রায়, তেজোর বাবা। কানের মধ্যে বাদ্যযন্ত্রের রেশ অল্প কিছুক্ষণেই মিলিয়ে যায়, কিন্তু চিঠি অবিনশ্বর। ধূসর কাগজে শুকিয়ে যাওয়া কলমের কালি তুলনায় অনেক বেশি জীবন্ত। রিটায়ার করার পর তেজোর চিঠির ফাইল খুলে বারান্দায় বসতেন বাবা, একাধিক বার নিজেকেই পড়ে শোনাতেন বছর দশেক ধরে বিভিন্ন সময়ে লেখা পত্রাবলি। 

            “এই সেই বিখ্যাত চিঠি!” নিজের মনেই বিড়বিড় করতেন ডঃ রায়। বিখ্যাত কারণ ওরই মারফত কলাম্বিয়া ইউনিভারসিটি থেকে ওর সিধান্ত বাড়িতে জানিয়েছিল তেজো। ডাক্তারি ছেড়ে জারনালিসম পড়ার সিধান্ত। ডাক্তার বাপ-মার মেয়ে যে ডাক্তার হবেই, এ ব্যাপারে পাড়া প্রতিবেশীর দ্বিমত না থাকলেও, নিশ্চিত ছিলেন না ওঁরা নিজেরাই। সায়েন্সের পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই পৃথিবী নিয়ে অপরিসীম আগ্রহ মেয়ের। কার্টুন দেখার মতোই চোখ গাড়া গাড়া করে গিলত ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের প্রোগ্রাম। অ্যামাজনের জঙ্গলে ইনকাদের লুপ্ত ইতিহাস, ভারতের প্রাচীন দ্রাবিড় সভ্যতা, চীনের প্রাচীর, মিসরের পিরামিড। আরেকটু বড় হয়ে কলম্বাসের আমেরিকা অভিযান, আফ্রিকা থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় ক্রিতদাশ আমদানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম ওয়ার। শুধু গান্ধি, মারটিন লুথার কিং, চে গুএভারা, মাও, ম্যান্ডেলাই কণ্ঠস্থ নয়, অনেক খুঁটিনাটি তথ্য শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিত তেজো। এই সব নিয়েই তখন রাতে খাবার টেবিলে এঁঠো হাতের আড্ডা। এর মধ্যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন উঠলে কথাই নেই, কথায় কথায় রাত কাবার হয়ে যাওয়ার যোগাড়। তর্কও লাগত মাঝে মাঝে। হিংসা বনাম অহিংসা, গান্ধি বনাম নেতাজি বা সূর্য সেন। 

            “তুই বড্ড একগুঁয়ে,” তর্কে এঁটে উঠতে না পেরে মেয়েকে বকতেন মা। “তোর সঙ্গে একমত না হলেই ভুল হবে কেন? আজ যেটাকে ভুল মনে হচ্ছে, গতকাল সেটাই ধ্রুবসত্য মানত লোকে।” 

            হাঁসপাতালের চেম্বার বা অপারেশান থিয়েটারের চার দেওয়ালের মধ্যে এ মেয়েকে আটকে রাখা যাবে না, বুঝেছিলেন ডঃ রায়। তেজোকে নিয়ে চিন্তা হলে, নিজেদেরই দুষতেন। চোখে ঠুলি বেঁধে সাধারণ ভাবেই ওকে মানুষ করা উচিত ছিল, আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিরা যেমন করে থাকে। অসাধারণ ঘটনাবলি আর বিষয়বস্তুর প্রতি আকর্ষণ ওকে বয়েসের তুলনায় পরিণত করে তুলেছে। অনেকের মধ্যে থেকেও ও একা, নিজের ভাবনার জগতে ঘুরে বেড়াতেই অভ্যস্থ। বন্ধুরা যখন খেলাধুলো, ফিল্ম স্টার, গানবাজনা, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড নিয়ে মশগুল, তখন ও ভাবছে চীনের রাজধানীতে তিএনানমিনের মর্মান্তিক ঘটনার কথা, মাথায় ঘুরছে সোমালিয়ার দুভিক্ষ আর বাংলাদেশের বন্যা। 

            এমনও হয়েছে, মা-বাবাকে চ্যালেঞ্জ করে তর্কের মধ্যেই চুপ করিয়ে দিয়েছে তেজো। “ইন্ডিয়ার মানুষেরই তো মেডিকাল সাহায্যের অভাব সবচেয়ে বেশি। ওদের ছেড়ে আমেরিকায় চলে এলে কেন তোমরা?”

            একে ওপরের মুখ চাওয়াচায়ি করেছিলেন ডাক্তার দম্পতি, সহজ কথায় উত্তর দিতে পারেননি। সেদিন গড়গড় করে বাবারই কাছে শেখা স্বামীজির উধৃতি শুনিয়েছিল  ওঁদের মেয়ে... “সাহসী মানুষই কেবল মহৎ কাজ করতে পারে। কাপুরুষেরা পারে না...।”

            “জারনালিসম পড়ে কী করতে চাস তুই?” বিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন। আপত্তির চেয়েও দুশ্চিন্তা হয়েছিল, টিভি-তে দেখা সেই সব ভয়ঙ্কর জায়গায় গিয়ে মেয়েকে কাজ করতে হবে ভেবে। নিজেকে বিপদে ফেলে খবর সংগ্রহ করা কতটা মহৎ কাজ, জানতে চেয়েছিলেন তেজোর কাছে। 

“মহৎ না, কিন্তু জরুরি,” বলেছিল তেজো। “ধরো, ভিয়েতনামে যে নাপাম বোমা ফেলে গ্রাম কে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল সেটা সাংবাদিকরা না লিখলে কেউ জানতে পারত, যুদ্ধ থামত?” কিংবা, চিলি-র গৃহযুদ্ধ, কিংবা কাম্বোডিয়ার গণহত্যা, কিংবা বাংলাদেশের লিবারেশান - ইত্যাদি নানান দৃষ্টান্ত তুলে সেদিন মা-কে বুঝিয়েছিল মেয়ে। 

            তারিখ ধরে ফাইলে তেজোর চিঠি সাজিয়ে রাখা ডঃ রায়ের বহুদিনের অভ্যেশ। ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর প্রথম অ্যাসাইনমেনট চলাকালীন, মানে ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল কভার করার সময় থেকেই। তারপর জেরুসালেম, গাজা, আফগানিস্তান, আবার জেরুসালেম, সুমাত্রা, সোমালিয়া। কখনও কখনও নিউ ইয়র্ক থেকেও লিখেছে, যেমন পুরুষবন্ধুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর লম্বা চিঠি লিখে বাবাকে প্রশ্ন করেছিল “সাফারিং” শব্দের প্রকৃত মানে কী।    

            ঘুম না আসায়, মনে মনেই বাবাকে লেখে তেজো। মরুভূমিতে প্রথম রাত কাটানোর রিপোর্ট। সঙ্গে চার্লি, জিসেল, মাইকেল, ডেভিডের পাঁচমিশেলি গল্প। ওর নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কায় থাকবেন বাবা, তাই যুদ্ধের খবরও যোগ করতে ভোলে না। কাছাকাছি শত্রুর কোনও ঘাঁটি নেই, অন্তত সেরকমই মনে করছে ওদের কমান্ডার। আলফা কম্পানি আগামী সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত আপাতত। কাজের কাজ সময় মতো চুকে গেলে সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যেই ফিরবে তেজো, ক্রিসমাসের আগেই, ছুটিটাও কাটাবে বাবার সঙ্গে। 

            অন্ধকারে বাবার মুখ এক ঝলক  ভেসে ওঠে। বারান্দায় বসে তেজোর ফাইলের পাতা ওলটাচ্ছেন। বাগানের ইউক্যালিপটাস হাওয়ায় দুলছে, ডালের ওপর কাঠবিড়ালি। মা ব্রেস্ট ক্যান্সারে হটাৎ চলে যাবার পর উনি একাই নিউ জার্সির বাড়িতে। বাবার পাশে নিজেকে দেখতে পায় তেজো, যেদিন মা-কে দাহ করে ফাঁকা বাড়িটাতে ফিরে এসেছিল ওরা দু’জন। কফি বানাতে উঠতেই, থামিয়ে দেন বাবা, নিজেই চলে যান কিচেনে। সেদিন ওঁর মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিল তেজো বাবা কী বলতে চাইছেন... “আজ না হয় আমার হাতেই খা, তারপর একদিন আসবেই যেদিন নিজের কফি নিজেকেই বানিয়ে নিতে হবে।”

Write a comment ...