ছয়

“ওদের মতে ৯-ই এপ্রিল ২০০৩-এই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। মানে যেদিন দুপুরে সাদ্দামের মূর্তি বাগদাদের ফিরদউস স্কোয়ার থেকে উপড়ে ফেলা হয়। বলা যায় সেদিন থেকেই আমেরিকান আর্মি বাড়ি ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।” 

            কফির কাপ হাতে আড্ডা মারছিল দু’জনে - তেজো আর মাইকেল। রিপোর্টারদের টেন্টের বাইরে, কাঁটাতারের বেড়ার এপারে। ওপারে সেনাবাহিনীর ব্যারাক। মাঝখানের মাঠে বাঁশের ডগায় নেট ঝুলিয়ে ভলিবল খেলছে মেরিন কোরের জনা বিশেক ছেলে, খালিগায়ে সর্টস পরে পাড়া মাতিয়ে রেখেছে।

            “সাদ্দাম গেলেই ইরাকের মুশকিল আসান! এত সহজ! যতসব ছেলেমানুষি!” বিদ্রূপের লক্ষ্য যে প্রেসিডেন্ট বুশ থেকে শুরু করে ওদের কমান্ডার লুক, মাইকেলের কথায় স্পষ্ট। “বলতে গেলে যুদ্ধ সবে শুরু হল বলে। ফাঁকা মসনদ মানেই বারো ভুতের কেত্তন। যার হাতে বন্দুক, সেই চাইবে তেলের মালিকানা, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের চাবি। প্রভুত্বের দাবিদার অনেকেই, আর এখনই তো মউকা।”

            টেলিভিশানে দেখা মূর্তি ভাঙার ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে তেজোর। বিশাল ষণ্ডামার্কা একজন দানবীয় হুংকার সহযোগে হাতুড়ি দিয়ে বেদম পেটাচ্ছিল লোহার সাদ্দামকে। শ-খানেক দর্শক ওকে তালি বাজিয়ে উৎসাহ দিলেও, সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি কেউই। ফিরদউস স্কোয়ারের উলটোদিকে প্যালেস্টাইন হোটেলের বারান্দায় বিদেশি রিপোর্টাররা ভিড় করে দেখছিল গোটা ব্যাপারটা। ক্যামেরাম্যানদের ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে মনে হচ্ছিল বিনা মেঘে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জখম হলেও ভেঙ্গে পড়েনি সেই মূর্তি, যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছোয় মার্কিন মেরিন। সর্দারি মেরে আমেরিকান ফ্ল্যাগে সাদ্দামের মুখ ঢেকে দেয়া মাত্র হুল্লোড় থেমে যায়। “ইরাক! ইরাক!” - চেঁচিয়ে ওঠে জনতা। তারই চাপে আমেরিকান ফ্ল্যাগ সরিয়ে ইরাকি পতাকায় মুখ বেঁধে, গলায় সেকল পরিয়ে টেনে হিঁচড়ে পদস্খলিত করা হয় সাদ্দামের প্রতিকৃতি। তারপর মরা কুকুরের মতো সেটা বাগদাদের রাজপথে প্যারেড করিয়ে ক্ষান্ত হয় জনতা। 

            টিভি-র পর্দায় চোখ রেখে সেদিন আফসোস হয়েছিল তেজোর। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার এই মাহেন্দ্রক্ষণে ঘরে বসে আছে বলে। বাগদাদে থাকলে চার্লির সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ত ঠিকই, ধূলিসাৎ সাদ্দাম নয়, পাকড়াও করত সেই হাতুড়িধারীকে। লোকটা কে, কেন এই আক্রোশ? ওরই জবানবন্দি চিনিয়ে দিত আক্রান্ত বাগদাদকে। 

            সেদিন মাইকেলের মতোই তেজোকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন ওর বস। এখুনি না হলেও, ভবিষ্যতে ইরাকে পাঠানো হবে ওকে। এটাই যুদ্ধের শেষ নয়, আরও বহু মুহূর্তের সাক্ষী হবে রিপোর্টার তেজস্বিনী রায়।

            বেড়া টপকে বলটা ওদের কাছাকাছি আসতেই, অনায়াসে ধরে ফেলে তেজো। ফেরত পাঠিয়ে দেয় মেরিনদের কাছে। শিষ দিয়ে থ্যাংক-উ জানায় ছেলেরা। 

            “বিপদে পড়লে এরাই হবে আমাদের রক্ষক। জানে বাঁচতে হলে এদের আশ্রয় ছাড়া উপায় নেই। আর সেটাই আসল বিপদ। রক্ষককে চটালে ইরাক থেকে আস্ত ফেরার চান্স কম” - মাইকেল বলছিলেন। বহু অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হলেও, ওঁকে জুনিয়ার রিপোর্টারের মতোই উদ্বিগ্ন শোনাচ্ছিল। “একদিকে আমাদের পাঠক বা দর্শক চায় আমরা সত্যিটাই তাদের সামনে তুলে ধরি, যতই তা ক্লেদাক্ত হোক না কেন। অন্যদিকে আমাদের কমান্ডার চাইবেন আমরা তাঁর এবং তাঁর রেজিমেন্টের গুণগান করি, ইরাকে আমেরিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হই।” 

            “যদি তা না করি? মানে, এমন যদি কোনও ঘটনা ঘটে যাতে...।”

            “যদি সমালোচনা করো?” মাইকেল তেজোর মনের কথা বুঝে নেন। 

            “রিপোর্টিং মানে যা, তাই। আর্মি যা বলছে, প্রত্যক্ষদর্শীর মতামতের সঙ্গে মিলিয়ে সত্যি-মিথ্যে যাচাই করে রিপোর্ট বানাই? হাঁসপাতালের বেডে শুয়ে আছে ক-জন, ক-জনকে কবর দেওয়া হয়েছে, জেনে-বুঝে হিসেব কষেই যা করবার করি, তা হলে?”

            হেসে ওঠেন মাইকেল। “তবেই হয়েছে! তা হলে তোমাকে যুদ্ধবিরোধী আখ্যা দেওয়া হবে। মিডল ইস্টে এটাই নিয়ম। হয় আমেরিকান নীতি মেনে নাও, না হয় শত্রু শিবিরে যোগ দাও। এতে তোমার বসও বিশেষ খুশি হবেন না। কেই বা চায় তার রিপোর্টার ক্যাম্প থেকে বহিষ্কৃত হোক।”

            “সবার ক্ষেত্রেই কি একই নিয়ম?”

            তেজোর প্রশ্নর উত্তরে ঘাড় দোলান মাইকেল। তারপর আশ্বস্ত করেন ওকে, “এর মধ্যেও ভাল কাজ করা যায়, যুদ্ধ মানেই শুধু হার-জিতের ব্যাপার না। তার চেয়েও বেশি কিছু - মনুষ্যত্বের পরীক্ষা। কোনটা বড় খবর আর কোনটা ছোট সেটা তো আর কমান্ডার ঠিক করে দেবে না, ঠিক করবে তুমি।” 

            খেলা শেষ করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আগে সোলজাররা হাত নেড়ে ওদের বিদায় জানিয়ে যায়। 

            আগেও মেরিনদের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে তেজোর - আফগানিস্তানে, সোমালিয়ায়। এই আঠারো, উনিশ, কুড়ি বছরের বড়জোর হাইস্কুল পাশ করা ছেলেদের সঙ্গেই রাত কাটাতে হয়েছে ট্রেঞ্চ বা ট্রাক বা ব্যারাকের মাটিতে কম্বল পেতে। আক্রমণের আশংকায় জেগেও থেকেছে বহু রাত। ভাগ করে ওদেরই খাবার খেয়ে রাঁধুনিকে গালমন্দ করেছে। জল ফুরিয়ে এলে সকলের বোতল গামলায় উপুড় করে চুমুক দিয়েছে পালা করে। গভীর রাতে পথ হারালে নাইট গগলস পরে খুঁজেছে একে ওপরকে। প্রয়োজনে মেরিনদের দেখাদেখি গ্যাস মাস্ক বা কেভলার ভেস্ট, অর্থাৎ বুলেট প্রুফ জ্যাকেট গলিয়ে বালির বস্তার ওপর চড়ে দুরবিনে চোখ রেখেছে, ফায়ারিং-এর আওয়াজে একে ওপরকে জাপটে ধরে পালিয়েছে নিরাপদ কোনও আশ্রয়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে রিপোর্টার আর সোলজারের মধ্যে তফাৎ সামান্যই। ওদের হাতে বন্দুক বা গ্রেনেড, তেজোর হাতে মাইক, চার্লির কাঁধে ক্যামেরা। মৃত্যুমনস্কতায় দু’পক্ষই এক।

            আর্মির সাহায্যে রিপোর্টিং করা মানেই আগে পিছে ট্যাঙ্ক, মাঝখানে সাংবাদিক। সুযোগ পেলেই মেরিনদের সঙ্গে খোশগল্প চালিয়ে গেছে তেজো। এরাও তো যুদ্ধের খবর, মানবিক স্টোরির সমান অংশীদার অবশ্যই। নিউ ইয়র্ক বা টেক্সাস বা ফ্লোরিডার নিরাপদ নিস্তরঙ্গ জীবন ছেড়ে মরুভূমির লড়াইয়ে সামিল হয়েছে কেন, আরবদের ভুত ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথাব্যাথা আছে কি না, ইরাক-আফগানিস্তান-সিরিয়া-সোমালিয়ায় নাক গলিয়ে আমেরিকার লাভ কী - এই সঙ্ক্রান্ত মতামত জানতে চেয়েছে। 

            ‘মেরিন কোর পাঠিয়েছে, তাই এসেছি।’ অথবা, ‘মেরিনে থাকলে বিদেশে ডিউটি করতে হয়,’ জাতীয় উত্তর পেয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হতে হয়েছে। বড়জোর আধা রাজনৈতিক গোছের মন্তব্য, ‘ওরা আমাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার উড়িয়ে দিয়েছিল, তারই বদলা নিতে এসেছি।’ ওরা কে, সাদ্দামের সঙ্গে ৯/১১-এর যোগাযোগ কী, ইত্যাদি প্রশ্ন করেও সদুত্তর পায়নি তেজো। বুঝতে সময় লেগেছিল, ওর পরিচিত আমেরিকানদের মতো এরা নয়। নিজেদের গণ্ডির বাইরে পৃথিবীর প্রায় কোনও খবরই রাখে না, অথচ অদ্ভুত এক স্বমহিমায় মজে আছে। যেখানে স্কুল পাশ করে ওর বন্ধুরা ইউনিভার্সিটির পথে পা বাড়িয়েছে, এরা স্কুল ফেল করে যোগ দিয়েছে মেরিনে। এদের মতো ছেলেদের কস্মিনকালে ডেট করেনি ওর কোনও বান্ধবী, ওদের নিউ জার্সির বাড়িতে মেরিন কোরের পদার্পণ হয়নি কোনদিনই। 

            কারন-অকারনে থুতু ছেটায় ছেলেগুলো, কথায় কথায় “ফাক।” ফাক অমুক, ফাক তমুক। ফাক! ফাক! ফাক! 

            মাইকেলের মন্তব্য চার্লির কানে তুলবে কি না ভাবে তেজো। এই গণ্ডিবদ্ধ পরিবেশ ক্যামেরাম্যানের পক্ষেও সমস্যাজনক নয় কি? তর্ক করতে পারে চার্লি। বলতে পারে, “তোমরা ভুগবে আমাদের চেয়ে বেশি।” “বেশি কেন?” “কারণ রিপোর্টারদের জ্ঞ্যান দেওয়া স্বভাব। সাধারণ ঘটনাকে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে অসাধারণ প্রতিপন্ন না করতে পারলে ভাত হজম হয় না। আমরা ছবি বিতরণ করেই খালাস!” পালটা তর্ক করে চার্লির ভুল ধরিয়ে দেওয়া তেজোর কাছে বিশেষ কঠিন কাজ নয়। এই পরিবেশে ছবিওয়ালাদেরও বিলক্ষণ নিয়ম মেনে চলতে হয়। যুদ্ধে জখম হয়েছে, এমন কোনও আমেরিকান সৈন্যর ছবি টিভি-র পর্দায় দেখানো চলবে না। মৃতদেহ বা কফিন নইব নইব চ। ইরাকি বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদ বা টর্চারের দৃশ্য লেন্সে ধরে ফেললে ক্যাম্প থেকে তৎক্ষণাৎ বহিষ্কার। এ ব্যাপারে শুধু ওদের কমান্ডার নন, গোটা আর্মিই বেজায় স্পর্শকাতর। শত্রুকে ভয় না পেলেও, মানবধিকার-ওয়ালাদের ভয় পায় না এমন কোনও যোদ্ধা আজকের দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আরেকটা অলিখিত নিয়মও মেনে চলতে হয় সাংবাদিকদের। কোনমতেই মেরিনদের চরিত্রহনন করা চলবে না, নষ্টামির মাত্রা যতই উঁচু হোক না কেন। 

            “কমান্ডার লুক তোমার খোঁজ করছিলেন,” দেখা হলে তেজোকে জানিয়ে দেয় চার্লি। 

            “আমার অপরাধ?”

            “অপরাধ না, এমনিই। নতুন যারা মেরিন ক্যাম্পে এসেছে, তাদের সঙ্গে ব্যাক্তিগত পরিচয় করে নিতে চান। নতুনদের গিফট-ও দিচ্ছেন বলে শুনেছি।”

            “কী গিফট?”       

            “সুইস চকোলেট। মরুভূমির সবচেয়ে দুর্লভ বস্তু!” হেসে ফেলে চার্লি। 

            হলিউডের কাউবয়দের মতোই চেহারা কমান্ডার লুক-এর। বছর পঞ্চান্ন বয়েস হলে কি হবে, বাচ্চা মেরিনদের মতো ছটপটে স্বভাব। অ্যাকশানের অদম্য নেশা বলেই ইদানিং কালের প্রায় সব যুদ্ধেই লড়েছেন, ভিয়েতনাম থেকে ইরাক। কথায় কথায় বিখ্যাত জেনেরালদের উদ্ধৃতি আউড়ে সাংবাদিক মহলে কিছুটা হাসির খোরাকে পরিণত হলেও, কাউবয় লুক-কে সমঝে চলে সবাই। পেন্টাগনের ওপর মহলের সঙ্গে ওনার দহরম মহরম আছে বলেই চাইলেই সব কিছু সহজেই পেয়ে যায় আলফা কম্পানি। কমান্ডার লুক সম্পর্কে নানা গুজব চালু থাকলেও, বিবিসি-র ডেভিড বার্নসের গল্পটাই সবচেয়ে লোমহর্ষক। বাগদাদ দখলের লড়াইয়ে হাইওয়ে ৬ ধরে এগচ্ছিল আলফা কম্পানি। ট্যাংক বাহিনীর পেছনে ট্রাক-কে-ট্রাক মেরিন, মাথার ওপর কোবরা হেলিকপ্টার। স্বাভাবিক নিয়মেই সাংবাদিকরা সকলের পেছনে। হটাৎ মুখ ঘুরিয়ে চলে আসেন কমান্ডার লুক, ডেভিড সমেত জনা তিনেক রিপোর্টারকে ওঁর জিপে তুলে “যুদ্ধ দেখাতে” বেরিয়ে পড়েন। “তেলের রিফাইনারি ধিক ধিক করে জ্বলছিল, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেদ করে বোঝা যাচ্ছিল না আমরা ঠিক কোথায়। তারই মধ্যে বোমা আর মর্টারের বিস্ফোরণ। মাথার ওপর দিয়ে সাই সাই গুলিবর্ষণে বোঝা যাচ্ছিল ইরাকিরা আমাদের বেশ কাছাকাছি। দু’পক্ষই মেশিন গান চালাচ্ছিল, আমরা ইষ্টনাম জপ করছিলাম।” সেদিন সত্যিকারের কাউবয়ের মতোই আচরণ করেছিলেন কমান্ডার, নিয়ম ভেঙে ট্যাংক আর হেলিকপ্টারের বেষ্টনী ছাড়িয়ে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে ফেলেছিলেন রিপোর্টারদের। “কমান্ডারের চোখদুটো আগুণের মতো জ্বলছিল,” ডেভিড বলেছিল সব্বাইকে, “ভয়ে সিটিয়ে ছিলাম আমরা, আর উনি বীরদর্পে এগিয়ে চলেছিলেন। হাসছিলেন আমাদের অবস্থা দেখে, ভাবখানা..... ‘যুদ্ধ দেখতে এসেছ? এবার বোঝো ব্যাপারটা কী!’” 

            “প্রথম দেখে তোমাকে মনে হয়েছিল আরবি। লোকাল মেয়ে। ভাবছিলাম মাথা ঢাকোনি কেন। এখন দেখছি তা তুমি নও।” 

            রাখঢাক না করেই শুরু করে দেন কমান্ডার। আমেরিকান ফ্ল্যাগ আর প্রেসিডেন্ট বুশের ছবি ছাড়া ওঁর টেন্ট বাকিদের মতোই ন্যাড়া। টেবিলের ওপর রাখা তেজোর ফাইলের পাতা ওলটাচ্ছিলেন কমান্ডার লুক।

            “এখন কী দেখছেন?” ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করে তেজো। 

            “দেখছি তুমি আমাদের মতোই আমেরিকান। ইন্ডিয়ান-আমেরিকান।”

            খশখশ করে পাতা উলটে যান কমান্ডার, তারপর কিছুটা আশ্চর্য গলায় প্রশ্ন, “আফগানিস্তানেও ছিলে দেখছি! খালি কাবুল না ফ্রন্ট-এ?” কাবুলে বসে রিপোর্ট করা মানে যে যুদ্ধের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে নিরাপদে সময় কাটানো - গলার স্বরেই তা প্রছন্ন।

            একটু ভেবে উত্তর দেয় তেজো, “অপারেশান মাউনটেন ভাইপার কভার করতে গিয়েছিলাম। কান্দাহার থেকে একশো পঞ্চাশ মাইল উত্তরে। জায়গাটার নাম জাবুল। গিয়েছেন কখনও?” 

            “জাবুলে গিয়েছিলে তুমি?” এবার আরও বড় বিস্ময়। “ওখানে আমাদের বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল শুনেছি। মেরিনও মারা গিয়েছিল অনেক।” 

            “অনেক না, ছ’জন। আসলে পাঁচ। একজন পাহাড়ে চড়ে ছবি তুলতে গিয়ে পা পিছলে মরে, যা কে ঠিক যুদ্ধের ক্যাসুয়ালটি বলা যায় না। সেই তুলনায় তালিবান মরেছিল অনেক। ১২৪ জন।”

            ফাইল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে এবার ভুরু কোঁচকান কমান্ডার লুক। “তোমার রিপোর্টে কর্নেল পাইপার-কে সমালোচনা করেছিলে দেখছি। বিজয়ীকে দোষারোপ কেন?” 

            “কারণ জাবুল দখল করে কর্নেল আমেরিকান আর্মিকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন, ভুলে গিয়েছিলেন সেকেন্ড ব্যাটালিয়ানের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিল আফগান সেনাবাহিনী। ওদের বীরত্বের কথা উল্লেখ করেননি।”

            “ও...” গুম হয়ে যান কমান্ডার, তারপর আবার প্রশ্ন। “এর আগে ইরাক আসনি কেন? ফ্যামিলির বারণ ছিল?”

            এবার হাসে তেজো। “বারণ থাকলে আফগানিস্তান গেলাম কীভাবে? ইরাকের যুদ্ধ তো তুলনায় নিস্তেজ। হাজার খানেক বোমা ফেলেও তালিবানকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। ইরাকিদের মতো আত্মসমর্পণের হিড়িক পড়েনি। এখানে যুদ্ধ যা হয়েছে তা তো সাদ্দাম বেঁচে থাকাকালীন, এখন যুদ্ধ কোথায়?” 

            মেয়ে বলে ওকে হেয় করছেন কমান্ডার। নইলে ফ্যামিলির প্রশ্ন উঠবে কেন? মাইকেল বা ডেভিড বা নির হলে এ জাতীয় মন্তব্য করতেন কি? পুরুষ রিপোর্টারদের ফ্যামিলির চাপ কিছু কম নাকি। নইলে রয়টার্সের বাগদাদ ব্যুরো চিফ ল্যারি হোলমস সব ছেড়েছুড়ে দেশে ফিরে গেল কেন? ওর বউ ওকে বলেছিল, তোমার কফিনের অপেক্ষায় বেঁচে থাকা আর আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। শুধু মেয়ে না, বাদামি চামড়ার মেয়ে। যে কিনা জিসেল বা সুজির মতো সম্পূর্ণ স্বাধীন কখনওই হতে পারে না। 

            “ইরাক আর আফগানিস্তান এক নয়, সেটা মানছি। তবে এখানেও বিপদ আছে, কিছুদিন থাকলেই বুঝবে।” এবার প্রসঙ্গ পালটান কমান্ডার, “আমার কাছ থেকে কী কী চাও বলে ফেলো। আজ আমার মুড ভাল, যা চাও পেয়েও যেতে পারো!” 

            প্রশ্নটার জন্য তৈরি ছিল তেজো। কমান্ডার এ প্রসঙ্গ না তুললেও, নিজেই তুলত ও। 

            “আমার গাইডের মেরিন ক্যাম্পে ঢোকার আর আমার সঙ্গে ঘোরবার পারমিশান করিয়ে দিন, যাতে রিপোর্টিং-এর কাজে ওর সাহায্য নিতে পারি।”

            “গাইড লাগবে কেন?” 

            “কারণ আপনি আমি কেউই আরাবিক জানি না। ভাষা না জানলে লোকালদের সঙ্গে কথা বলব কী করে?” 

            “কেন, আমাদের মেরিন ট্রান্সলেটাররা কী দোষ করল?” 

            “আপনাদের ট্রান্সলেটার? ওরা তো গুটিকতক লাইন ছাড়া কিচ্ছু জানে না। ওদের আরাবিক মানে, ‘ইখমাদ বান্দিকাকুম’ - বন্দুক নামাও - কী বড়জোর “নান আমরিকিউন, নান আসদিকায়িক - আমরা আমেরিকান, আমরা তোমাদের বন্ধু। ব্যাস!”

            “তোমার গাইড কি...”

            “ইরাকি।” প্রশ্ন শেষ হবার আগেই উত্তর দিয়ে দেয় তেজো। “শিক্ষিত, ভদ্র, আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন মানুষ। যুদ্ধে অনেক কিছু হারিয়েও মনুষ্যত্ব হারায়নি এমন একজন।”

            “গুপ্তচর নয়, প্রমাণ আছে?” 

            মাথা নাড়ে তেজো। “না। তবে যুদ্ধের আগে বাগদাদের আমেরিকান সেন্টারে লাইব্রেরিয়ানের কাজ করত আমের। মনেপ্রাণে আমাদের শত্রু হলে সে কাজ করা সম্ভব হত কি?” 

            ঠোট ওলটান কমান্ডার লুক। “এদেশে কিছুই বিচিত্র নয়। কাল যে ছিল সাদ্দাম-পন্থি, আজ সে সাদ্দাম-বিরোধী। আগামী কাল সে কী হবে, কে বলতে পারে।”

            “যার দল ভারী, তার দিকেই যাবে। এতে আশ্চর্যের কী আছে? বেঁচে থাকাটাই তো মানুষের একান্ত কর্তব্য, তাই না?”

            “তার মানে?” 

            “যেহেতু সাদ্দাম হেরেছে আর আমরা জিতেছি ভবিষ্যতে আমাদের দিকেই থাকবে আমের, অন্তত সাধারণ যুক্তি তাই বলে।”

            মুচকি হাসেন কমান্ডার লুক। “ আরেব্বাস, এ শুধু আমেরিকান না, ইন্টেলিজেন্ট আমেরিকান দেখছি! রীতিমত কলেজে পড়া ইন্টালেকচুয়াল, আমাদের মতো এলেবেলে মেরিন না! জেনরাল উইলিয়াম শেরমানের নাম শুনেছ তো?” 

            ঘাড় নাড়ে তেজো, “আমেরিকান সিভিল ওয়ারে ইউনিয়ানিস্ট সেনাবাহিনীর নেতা।” 

            “ঠিক, ঠিক। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে ধরে ধরে সব ক’টা রিপোর্টারের গলা কাটতাম, জেনরাল শেরমান বলেছিলেন। তবে এও বলেছিলেন যে তাতে কোনও লাভ হত না। নরকে পৌঁছে পরদিনই আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট ফাইল করে দিত ব্যাটারা!”

            দু’জনেই হোহো করে হেসে ওঠে, তারপর টেন্ট ছাড়ার আগে তেজোকে ওঁর গিফট দেন কমান্ডার লুক। গোলাপি রঙের মাথা ঢাকার চাদর হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে তেজো, “এটা কেন?”

            “কারণ এটাই এখানকার আদত। আরেবিয়ায় এসে আরেবিয়ান না সাজলে খবর পাবে কোত্থেকে?”            

            কমান্ডারের টেন্টের বাইরে অপেক্ষা করছিল চার্লি, তেজো বেরতেই চেপে ধরবে বলে।

            “কী হল?” 

            “ব্যাবস্থা হয়ে গেছে, আমেরকে বলে দাও কাল থেকেই কাজে লেগে যেতে।” 

            খুশিতে ঝলমল করে ওঠে চার্লি। আমের ওর বন্ধু, বছরখানেক আগেই দু’জনের পরিচয় হয়েছিল বাগদাদে। রাজধানী খুইয়ে দিশেহারা ইরাকিদের মতোই আমেরও তখন হিমশিম খাচ্ছে। আমেরিকান সেন্টার বন্ধ, লাইব্রেরির চাকরি আছে না নেই কেউ বলতে পারে না। তিন তিনটি সন্তান, তৃতীয়ের জন্ম দিতে গিয়ে স্ত্রী মারা গেছে দু’বছর আগে। শাশুড়ি-মার হাতেই বড় হচ্ছিল আমেরের তিন মেয়ে। যুদ্ধ লাগার পর ওনাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল আমের, রাজি হননি খাদিজা। বলেছিলেন, “মরলে আমরা একসঙ্গে মরব - বাবা আর দিদিমার হাত ধরেই মা-র কাছে যাবে তোমার মেয়েরা।” ভদ্র আর বিচক্ষণ বলে আমেরের সঙ্গে কাজ করতে চায় সব বিদেশি সাংবাদিকই। তবে চার্লিকেই ওর পছন্দ। আমেরের সঙ্গে দেখা করতে কাউকে না জানিয়েই ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে যায় ওর ক্যামেরাম্যান, তেজো বিলক্ষন জানে। 

            “দারুণ খবর! কী করে কমান্ডারকে মানালে বলত?” 

            “কেন, না মানবার কী আছে?” 

            “আছে বইকি। আরবি জানে এমন লোককে মেরিনরা বিশ্বাসই করে না। ভাষাই তো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রধান কারণ।” 

            “তুমি কি ওকে বিশ্বাস করো?” চার্লির চোখে চোখ রাখে তেজো। 

            একটু থেমে উত্তর দেয় চার্লি, “করি।”            

            “সম্পূর্ণ ভাবে করো?”

            “সম্পূর্ণ?” চাউনিতে একরত্তি মেঘ জমিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিমি হেনড্রিক্স, “সম্পূর্ণ ভাবে কে কাকে চিনেছে কবে?”

            টেন্টে ফিরে নিজের কাছেই দিনের হিসেব নেয় তেজো। কমান্ডার লুকের সেই কথাগুলো মনে পড়ে... “প্রথম দেখে তোমাকে মনে হয়েছিল আরবি।” মনে মনে হাসে তেজো। এই হল বাদামি চামড়ার গুণ! চরম বিভ্রান্তিজনক। জাতি-বর্ণ নির্ণয় অতি দুরূহ কাজ। একদিকে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-নেপাল, অন্যদিকে আরেবিয়া, এমনকি গোটা দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে এই গোলমেলে রং। পকেটে যে দেশের পাসপোর্টই থাকুক না কেন, মালিকের জন্মভূমি নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া অসম্ভব। “গুপ্তচরবৃত্তির জন্যে তোমরা ইন্ডিয়ানরা একেবারে আদর্শ!” ঠাট্টা করতেন ওর বস, “এক নজরে কেউ বলতে পারবে না লোকটা কোথাকার, যা খুশি তাই বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে!”

            কমান্ডারের দেওয়া গিফটের প্যাকেট খুলে চাদরটা মাথায় জড়িয়ে নেয় তেজো।  মেক আপের আয়নায় নিজেকে দেখে। বাঙালি তেজস্বিনীকে আরেবিয়ান বলে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে কি? গোলাপি ঘোমটার তলায় বাদামি ত্বকের ওপর হাল্কা একটুখানি প্রলেপ। তফাৎ বলতে এই। তা কি কয়েক রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে বলে? নাকি এটাই মরুভূমির ছাপ? 

Write a comment ...