এক

মাঝরাতে অকারণে ঘুম ভাঙানোর কেউ নেই বলেই, ফোনটাকে চুপ করিয়ে রাখার প্রয়োজন হয় না তেজস্বিনীর। রিং বাজলে বুঝতে হবে ডাক এসেছে। গড়িমসির দোহাই দিয়ে বিছানা আঁকড়ে থাকার প্রশ্নই নেই, তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে যাবে যাবতীয় কার্যকলাপ। হাতে এক ঘণ্টা সময় থাকলে স্নান, নয়তো রাতের পাতলুন ছেড়ে সরাসরি কাজের পোশাক। ব্যাগটা গুছিয়ে রাখা অনেকদিনের স্বভাব, যার মধ্যে সপ্তাহ-দুয়েকের কাপড়জামা আর মশার ক্রিম, ফ্লাস্ক, টর্চ, ব্যাটারি চার্জর বা টুকিটাকি ওষুধপত্র ছাড়াও একটা ছোট মেকআপ কিট অত্যন্ত আবশ্যিক, কারণ প্রেক্ষাপট যতই মলিন হোক, রিপোর্টারের উজ্জ্বল মুখশ্রী দেখতেই অভস্থ টিভি-র দর্শক।

            প্রতিবেশী অ্যালিসের দরজায় একটা চিরকুট লাগিয়ে দিলেই হল, ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি খুলে দু’বেলা কিম, অর্থাৎ বেড়ালটাকে খাইয়ে দেবে ও বা ওর পার্টনার জন। সপ্তাহে এক দিন গাছে জল আর প্রিয় বনসাই-এর ডালগুলো ছেঁটে দেওয়া ছাড়া ফাঁকা বাড়ির হ্যাপা সামলানো অতীব সহজ। বাড়ি তো মানুষ না, যে কিনা মালিকের অবর্তমানে ভেঙে পড়বে, বা রাস্তা বুঝে চলে যাবে নিজের আস্তানায়। বরং মাস কী বছর ঘুরে গেলেও সে অপেক্ষা করবে যতক্ষণ না বিশ্বভ্রমন সেরে নিজের জমিতে ফিরে আসে তেজস্বিনী, ব্যাগ উপুড় করে সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে কফির কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, চোখ মেলে দেয় অতি পরিচিত নদীটার দিকে যার পাড় ঘেঁষেই তার প্রিয় নিউ ইয়র্ক।

            ফোন বাজার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ওর গন্তব্যস্থল বোঝা যাবে। মেক্সিকো হলে প্লেনে আরও সাত ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়ে পারবে। সিরিয়া বা ইরাক হলে বারো। চিন বা ভারতের বেলায় কথাই নেই, রীতিমত কুম্ভকর্ণ পালা। এই ঘুমটুকুই ওর পর্যাপ্ত জীবনের একমাত্র দুর্লভ বস্তু। আর পাঁচটা রিপোর্টারের মতোই কাজের ফাঁকে ঝিমিয়ে নেওয়া স্বভাব বলেই, বাস কী ট্রেন কী প্লেন, সর্বত্রই সহযাত্রীর কাঁধে ঘাড় এলিয়ে দিতে আপত্তি নেই। ওদের ভাষায় একে বলে পাওয়ার ন্যাপ। রাত জেগে স্টোরি কভার করা বা সপ্তাহভর যুদ্ধক্ষেত্রে কাটাবার পক্ষে যা একান্ত প্রয়োজন। চটপট ঘুমিয়ে পড়া আর তড়িঘড়ি জেগে ওঠা, দুই-ই দখলে যার, আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার জগতে তার সাফল্য সুনিশ্চিত। 

            সফল বলেই তেজস্বিনীর ডাক আসে অন্যদের তুলনায় বেশি। কী একটা ক্ষমতা আছে মেয়েটার যার জোরে ও টক্কর দিতে পারে ঘাগু পোড় খাওয়া খবরওয়ালাদের। কঠিন মক্কেলের পেট থেকে আসল জিনিশ বের করে আনবার ক্ষমতা। নার্ভ ঠিক রেখে ঝামেলার মধ্যেই কাজ হাসিল করা। চাপের মুখে প্রশ্নর খেই হারিয়ে না ফেলার ক্ষমতা। প্রয়োজনে মেজাজ কিম্বা হাসিমুখ দেখানোর মতো বিচক্ষণতা আছে বলেই যে কোনও কর্ডন ভেদ করা ওর কাছে জলভাত। প্রথম দিনই ওকে চিনে ফেলেছিলেন ওর বস। ব্রেজিলের এক কুখ্যাত জেলে রায়ট লাগার টাটকা খবর আসতে না আসতেই, হাত তুলেছিল সদ্য চাকরি পাওয়া তেজস্বিনী। “তুমি যাবে আলকাকুজ-এ!” ওটা যে নির্ঘাত মরণফাঁদ, জানতে বাকি নেই কারুর। জেল তো নয়, ড্রাগ মাফিয়ার রাজত্ব। গত বছরই দুই গ্যাং-এর মারপিটে মারা পড়েছিল এক ডজন ক্রিমিনাল। ওখানকার গার্ড-দেরও যথেষ্ট দুর্নাম, খুনখারাপিতে বন্দিদের চেয়ে কোনও অংশে কম না। ওদেরই কাউকে খতম করে রোস্ট বানিয়ে গিলেছে ক্রিমিনালগুলো, ভিডিও তুলে দেখিয়েছে জেলের বাইরে সব্বাইকে - অন্তত সেটাই গুজব। আর্মি নামিয়ে আলকাকুজকে ঘিরে ফেলেছিল ব্রেজিলের সরকার, আর সেই কঠিনবন্ধনির পাশ কাটিয়েই জেলের সদরদপ্তরে ঢুকে পড়ে তেজস্বিনী, একের পর এক সাক্ষাতকারে ফাঁস করে দেয় মাংস রান্নার আসল রহস্য। আদৌ ওটা নরমাংস ছিল না, গার্ড-দের পোষা কুকুর, যা কিনা জেলের খাদ্যর চেয়ে অনেক গুন সুস্বাদু।

            মাত্র কয়েক বছর আগে, সুনামির খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে। ষাট ফুট উঁচু ঢেউর ধাক্কায় হিরোশিমার মতো ধূলিসাৎ শহর-গ্রাম, লক্ষাধিক মৃতদেহ। কবরের কাঠ নেই, ধু-ধু জ্বলছে চিতার আগুন। তারই ভেতর মাইক হাতে তেজস্বিনী। ভয় পেয়েছিল সংবাদ সংস্থার অনেকেই। ওই নরকের মধ্যে বাচ্চা রিপোর্টারকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে কি? কলেরা-টাইফয়েড তো বটেই, খুন-ডাকাতি-ধর্ষণের ভয়ে সুমাত্রার পথে পা মাড়াচ্ছে না আর পাঁচটা বিদেশি চ্যানেল। বসের নির্দেশ স্বত্বেও সেবারে ফিরতে রাজি হয়নি তেজস্বিনী। কারণ সৈনিকের মতোই, সংকট ছেড়ে পলায়ন সাংবাদিকের পক্ষে অসম্মানজনক। 

            ঠিক তেমনই, রাষ্ট্রসংঘের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ওই প্রথম সোমালিয়ার সন্ত্রাসবাদী আল-শাবাবের শেখকে মগাদিশুর ডেরায় ধরে ফেলে। একে বিদেশি সাংবাদিক, তার ওপর মহিলা। বোরখা, চাদর, দুপাট্টা, নিকাবহীন রিপোর্টার।  স্বেতাঙ্গিনি নয় অথচ ইংরেজিভাষী। বাদামি এশিয়ানের দু’এক কথায় মজে গিয়ে আশ্চর্য সব তথ্য উজাড় করে দেন শেখ, যার সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে তাকে নিধন করে মার্কিন সেনাবাহিনী।  

            তেজী বলেই তেজস্বিনী। বিদেশিরা ডাকে - তেজো। নিউ ইয়র্কে বসেই সাংবাদিকতা করার অফার এসেছে বেশ কয়েকবার। উঁচু পোস্টের চাকরি, খবরের মুখ হয়ে রিস্ক-ফ্রি জীবন কাটানোর প্রলোভন। ফিরিয়ে দিয়েছে তেজো। স্টুডিওর নিরাপদ আশ্রয় নয়, এই ঘটনাবহুল পৃথিবীর টানই সাংবাদিকতার মুল আকর্ষণ, বারংবার যা ওকে পৌঁছে দেয় খবরের গর্ভগৃহে। যেখানে ভূমিকম্প, সুনামি, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, জেনোসাইড, যুদ্ধ, সেখানেই রিপোর্টার তেজস্বিনী রায়। 

            মাঝরাতে ফোন পেয়ে প্রায় নিঃশব্দেই প্রস্তুত হয়ে নেয় তেজো। সঙ্গী বলতে ক্যানভাসের ব্যাগ আর পাসপোর্ট। পকেটে চুইং গাম। এক ঝলক আয়েনায় দেখে নেয় নিজেকে। আদর করতেই জেগে ওঠে কিম, অর্থবহ মায়াবী দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। ঘরের আলো নিভিয়ে শহরের আলোয় বেরিয়ে পড়ে তেজো।  

Write a comment ...