সাত

মেরিনদের সঙ্গে ব্র্যাডলি চড়ে যুদ্ধে যায়নি যে সাংবাদিক, সে বুঝবেই না কী ভীষণ ক্লান্তিকর এই যাত্রা। ব্র্যাডলি মানে আরমার্ড কার, অর্থাৎ ছোটখাটো ট্যাংক। দম আটকানো গরম, বাতাশহীন অন্ধকূপের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। ঘাড়ের ওপর জনা পাঁচেক ঘেমো, চুইং গাম চেবানো, থুতু ফেলা মেরিন। জানলা বলতে গুটিকতক তিন ইঞ্চি বাই ছ’ইঞ্চি ঘুলঘুলি, যার ভেতর দিয়ে পৃথিবীটাকে চিনে ওঠা প্রায় অসম্ভব। ওয়াকি-টকি শুনে আন্দাজ করে নিতে হবে ওদের যাত্রা ঠিক কোনদিকে - উত্তরের শহরাঞ্চল নাকি পশ্চিমের তেলের খনি।

            ক্লান্তিকর হলেও, তেজোর মেজাজ ভাল। ক্যাম্পের খবরহীন জেলখানা ব্র্যাডলির চেয়েও ক্লান্তিকর। কমান্ডার লুক আজ ওদের নিয়ে বেরবেন, খবরটা রিপোর্টারস মেসে পড়তে না পড়তেই সাজ-সাজ রব উঠে যায়, বন্ধুত্বের রেশ কেটে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে গনগনে প্রতিযোগিতার মেজাজ। কে কোথায় জায়গা পাবে, ট্যাংক না ব্রাডলি না কমান্ডারের নিজস্ব জিপ-এ, তাই নিয়ে হুলুস্থুল। বেরবার আগে আমেরের সঙ্গে তেজোর আলাপ করিয়ে দেয় চার্লি। ওরা দু’জনে একসঙ্গে যাবে, আগেভাগে চার্লি। 

            “গুড মর্নিং, স্যার!” মাথা ঝুঁকিয়ে তেজোকে অভিবাদন জানায় আমের। 

            “স্যার! স্যার কেন?” অবাক হয় তেজো।  

            “বুঝলে না?” ফিসফিস করে চার্লি। “আরে বাবা, অপরিচিত মহিলার সঙ্গে ঝট করে মিশবে না এখানকার কোনও পুরুষমানুষই। অথচ এখন তুমিই ওর মালিক, যাকে অগ্রাহ্য করাটাও অপ্রীতিকর। তাই স্ত্রীলিঙ্গকে পুংলিঙ্গ বানিয়ে ম্যানেজ করছে!”

            “তার মানে সারা রাস্তা স্যার স্যার করবে নাকি?” এমন অদ্ভুত যুক্তি কোনদিন শোনেনি তেজো।

            “না, না, একটু পরেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমাদের আমির উচ্চশিক্ষিত ব্যাক্তি, অচিরেই নিজেকে ঠিক বুঝিয়ে নেবে।”

            প্রথম দর্শনে পাট করা কালো চুল আর মিহি গোঁফের সুদর্শন মালিক আমেরকে তেমন লাজুক বলে মনে হয়নি। সরকারি অফিসারদের মতো সাদা সার্টের ওপর যত্ন করে বাঁধা টাই, মাথায় ফরাসি বেরে - কে বলবে ও রিপোর্টারদের সামান্য লেজুড় বই কিছু নয়। অনেকেই ওকে চেনে, প্রেসের লোকজনের সঙ্গে করমর্দন করার ফাঁকে জিসেলের সঙ্গে ফরাসিতে আলাপ করছিল স্বছন্দে। এমনকি ম্যাড্রিডের লা পাইয়েস-এর গোমড়ামুখো মানুএল সিগারেট বাড়িয়ে দিলে হাসিমুখে ফিরিয়ে দেয় আমের। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল নিউ ইয়র্ক, প্যারিস বা লন্ডনেরই কোনও সাংবাদিক। চার্লির কথায় ফিরে যায় তেজো... ‘যুদ্ধ লাগলে কেরিয়ার বলে কিছু থাকে না...ইঞ্জিনিয়ার বনে যায় ড্রাইভার, আর্টিস্ট চোরাকারবারি।’ কথাটা যে খাঁটি, তার প্রমাণও পেয়েছিল তেজো, আফগানিস্তানে এক মালবাহী কুলির মুখে ঝরঝরে ইংরেজিতে গীতাঞ্জলীর আবৃত্তি শুনে।       

আমেরের চেহারায় কার সঙ্গে জানি মিল পায় তেজো। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! ভিডিও ক্যাসেটে পুরনো দিনের বাংলা ছবি দেখতেন মা বাবা। হ্যান্ডসম হিরোর ফ্যান ছিলেন বিনা, বাবা মা-কে খ্যাপাতেন সেই নিয়ে।             

            ক্যাম্প ছাড়ার আগে সবাইকে লেকচার দিচ্ছিলেন কমান্ডার লুক। আজ সকালে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে একটা ঘটনা ঘটেছে, আর্মির ভাষায় যাকে বলা হয় এনকাউন্টার। আরও খোলসা করে বললে সুইসাইড বোমা। একটা না দুটো। আল-ফাতসি শহরের বাজারে আর মসজিদ চত্বরে। হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিরোধ থাকলেও, আক্রমণকারীরা এখনও আশেপাশে কোথাও আত্মগোপন করে আছে বলেই আঞ্চলিকদের বিশ্বাস। 

            “আমাদের কাজ পুরো জায়গাটা সংরক্ষিত করা, আর দুই - টেররিস্টদের খতম।” 

            “যারা আঘাত পেয়েছে তাদের চিকিৎসার কী ব্যাবস্থা হবে?” কমান্ডারকে প্রশ্ন করেন মাইকেল রুবিন। 

            “ওটা আমাদের ব্যাপার না। ইরাকি অ্যাডমিন্সট্রেসান ওসব সামলাবে।” 

            “যারা কিনা বেগতিক বুঝে আগেভাগেই চম্পট দিয়েছে!” ফিসফিস করে সব্বাইকে হাসায় ডেভিড। 

            ব্র্যাডলিতে গুড়িসুড়ি মেরে আমেরকে জিজ্ঞেস করে তেজো আগে কখনও আল-ফাতসিতে গিয়েছে কি না। 

            “নো স্যার। বেড়াতে যাবার মতো শহর না ওটা।”

            “তুমি স্যার বললে আমিও তোমায় স্যার বলব কিন্তু,” শাসায় তেজো। তারপর আরও কিছু জরুরি তথ্য জেনে নেয় - ওটা শিয়া না সুন্নি প্রধান এলাকা, তেলের খনি কদ্দুর, ওই অঞ্চলে আমেরিকান সৈন্য শেষ অভিযান করেছিল কবে, সাদ্দাম অনুগতদের অবস্থান কী।

            “আল-ফাতসি না গিয়েই এত কিছু জানলে কী করে?” আমেরের উত্তরগুলো নোটবইয়ে টুকে নিয়ে ফের জেরা করে তেজো।

            “বিবিসি, সিএনএন বলেছে, তাই জেনেছি,” এবার সপ্রতিভ উত্তর। 

            “মানে ইরাকের খবর বিদেশিদের মুখ থেকেই পাচ্ছে ইরাকিরা!” 

            “হ্যাঁ, স্যার। এখন বিদেশিরাই বেশি নিরাপদ ইরাকে।” 

            “আবার স্যার!” শাসনের মাত্রা বাড়াতে “সরি” বলে ক্ষমা চায় আমের। 

            ব্র্যাডলি থেমে যেতেই মেরিনদের চিৎকারে ওরা বুঝতে পারে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে। গাড়ি থেকে নামতেই চার্লির হাঁকডাক। আঠারোটা মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে ইতিমধ্যেই, ধ্বংসস্তূপের নীচে এখনও চাপা পড়ে আছে বহু মানুষ। ক্যামেরা আর মাইক হাতে দৌড়য় ওরা তিনজন। 

প্রথম বোমা যেখানে ফেটেছিল সেখানে ফুট পাঁচেক চওড়া একটা গর্ত। দু’পাশে লণ্ডভণ্ড দোকানপাট। আনাজপাতি, তেলের টিন, রান্নাবাটির সাজসরঞ্জাম, কাপড়জামার বস্তা রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার দরুন জায়গাটা আবর্জনার স্তূপ বলে ভুল হতেই পারে। তারই মধ্যে রক্ত, ছিন্নভিন্ন শরীরের অংশবিশেষ। উদ্ধারকার্যে ব্যস্ত এক দল ছেলে মেরিনদের হাতে হাত মিলিয়ে পাথরের চাঙড়ের তলায় চাপা পড়া মানুষগুলোকে খুঁজছে। 

ওদের দেখেই একটা হইচই লেগে যায়। এক লাফে চার্লির কাছে পৌঁছে ওকে আড়াল করে দাঁড়ায় আমের। বিরাট দাড়িওয়ালা গলদঘর্ম যে লোকটা কোদাল হাতে ক্যামেরার দিকে চোখ রাঙিয়ে গালমন্দ করছিল, তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করে, যার মধ্যে “সাহাফি আম্রিকি! লেয়েস আলেয়াদুই!” অর্থাৎ “এরা আমেরিকান জারনালিস্ট, এরা আমাদের শত্রু নয়” শুধুমাত্র এইটুকুই বোধগম্য। মেরিনরা জায়গাটা কর্ডন করে ফেললেও, আত্মীয়-বন্ধুর খোঁজে প্রায় গোটা শহরটাই রাস্তায় নেমে পড়েছে, মাইকে ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা মানছে না কেউই। বাজারের চৌহদ্দির বাইরে আধপোড়া একটা গাড়ি, বনেট থেকে ধোঁয়া উঠছে তখনও। সম্ভবত ওটাই চালিয়ে এসেছিল সুইসাইড বমবার। কানের মধ্যে ক্রমাগত ফিসফিস করে যাচ্ছে আমের, আর মাইক হাতে ক্যামেরায় চোখ রেখে রিপোর্ট পেশ করছে তেজো, ওর তালে তাল মিলিয়ে ভিড় ঠেলে দৌড়চ্ছে চার্লি। 

মুখোমুখি হতেই চেঁচিয়ে ওঠে জিসেল, মসজিদের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায়। ওখানেই দ্বিতীয় বোমাটা ফেটেছিল, ফজরের প্রার্থনা শুরু হবার ঠিক আগে। তখনও মসজিদের চত্বর ভর্তি হয়নি পুরোপুরি, ওজু করতে ব্যস্ত অনেকেই। বাজার সেরে প্রার্থনায় যোগ দিতে যাবার পথেই প্রথম বিস্ফোরণ। আজানের ডাক ছাপিয়ে তার পরেরটা। 

হটাৎ তেজোকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠেন এক বয়স্কা মহিলা। কান্নার ফাঁকে  এক-এক করে অজস্র অভিযোগ, কখনও সাদ্দামকে দুষছেন, কখনও বা আমেরিকানদের। ভাগ্যকেও গালমন্দ করতে ছাড়ছেন না। “কী হয়েছে ওঁনার?” আমেরকে জিজ্ঞেস করে তেজো। “স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছেন না, হন্নে হয়ে ঘুরছেন সারা সকাল। আজই ওঁদের শহর ছেড়ে ছেলের কাছে টার্কিতে চলে যাওয়ার কথা।” আরও অনেকেই ঘিরে দাঁড়ায় ওদের, যেন পারলে ওরাই প্রিয়জনদের ফিরিয়ে দিতে পারবে। চোখ দিয়ে ইশারা করে চার্লি, “দেখো...”

রক্তাক্ত চাদরে মোড়া মুণ্ডহীন ধড় তিনটে শুয়ে আছে মসজিদের দোরগোড়ায়, মনে হচ্ছে বলি দিয়ে ভেট দিয়েছে কেউ। পরিচিত হলেও এই অবস্থায় চিনে নিতে অসুবিধে হচ্ছে বলেই নিস্পলক তাকিয়ে আছে অনেকে। হট্টগোলের মধ্যেও থমথমে পরিবেশ। ক্যামেরা তাক করলে, চার্লিকে থামিয়ে দেয় তেজো। আর কত শবদেহ দেখাবে ওরা? ইরাক মানেই বিশাল একটা ভাগাড়, এতদিনেও কি এটা বোঝেনি টিভি-র দর্শক? সুইসাইড বোমা, ল্যান্ড মাইন, মর্টার, আরপিজি, মেশিন গান, গ্রেনেড, আমেরিকান বমবিং - সবকিছুর নেট ফলাফল এই শব। ওদের বস-ও বিশেষ খুশি হবেন না, কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে যাই ঘটে ঘটুক, টেলিভিশানে তার মর্মান্তিক ছবিগুলো তুলে ধরা অনুচিত। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে, যুদ্ধের মজাটাই বেমালুম কেটে গেলে চ্যানেল পালটে নিতে পারে ওদের দর্শক। 

বাচ্চা একটা মেয়ে শবগুলোর পায়ের কাছে ফুলের স্তবক রেখে গেল। কে ও? মৃতদের ছোট বোন? ওদেরই পরিবারের কেউ, না কি এরা এই বাজারেরই দোকানদার যাদের থেকে রোজ ফুল কিনত মেয়েটি? 

মৃত নয়, বরং যারা বেঁচে আছে তাদের নিয়ে স্টোরি করাই শ্রেয় - নিজেকে বুঝিয়েছে তেজো। মৃত্যুর ধাক্কা কাঁধে নিয়ে যাদের বাঁচতে হবে সারা জীবন। কফিনের ডালা বন্ধ হলেই ট্র্যাজেডি পালার শেষ ঘণ্টা বেজে উঠবে না। যদিও এই মৃত্যু নিয়েই বিলক্ষণ আহ্লাদ কী সৈনিক কী রিপোর্টারের। এতে সুবিধে অনেকঃ তথ্য, পরিসংখ্যান দিয়ে রিপোর্ট ভরিয়ে দেওয়া যাবে, শবদেহ ঘেঁটে শত্রু-মিত্র বিচার হবে, হার-জিতের খেলায় এটাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। ভেবে দেখতে গেলে কাজটা সহজও, প্রশ্ন করবে না শবদেহ, কৈফিয়ত চাইবে না কারুর কাছেই। 

“ওই মেয়েটার বাড়ি একবারটি ঘুরে যেতে চান কি?” 

“তাই চলো।” আমেরের কথায় সায় দিয়ে ভিড় ঠেলে বেরোয় তেজো আর চার্লি।

দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মুসা। উনিই আল-ফাতসির একমাত্র নাপিত। ক্রিশ্চান হলেও ওঁর কাছে চুল-দাড়ি কামাতে আসে শিয়া, সুন্নি, কুর্দ - সবাই। পরিপাটি সেজেগুজে, বগলে খবরের কাগজ নিয়ে ফ্যালফ্যালে চোখে আমেরের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন মুসা, কোলের কাছে সিধিয়ে ওঁর নাতনি - সেই ছোট্ট মেয়েটা। বাড়িতে ক’জন থাকেন? উত্তরে ভেতরের ঘরটা দেখিয়ে দিলেন, যেখানে মাটিতে বসে ওঁর মেয়ে আর গোটা পাঁচেক নাতিনাতনি।

“বাবা কই?” সবচেয়ে বড় ছেলেটাকে প্রশ্ন করে আমের। 

উত্তর নেই। 

“বোমা ফাটার সময় কোথায় ছিলে তোমরা, কী করছিলে?” 

এবারও উত্তর নেই। জুলজুল করে সবাই দেখছে ওদের, জানলার বাইরে একদল কুকুর একঘেয়ে ডেকেই চলেছে। 

“তোমার বাবাই কি....?” 

চার্লি আর তেজোকে ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যায় আমের, এই পরিবারে ঠিক কী ঘটেছিল খবর নিয়ে ফিরে আসে। প্রথম বিস্ফোরণের পরই মেয়েটির বাবা ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যান কী হয়েছে দেখতে। দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে মসজিদের দিকে হাঁটা লাগান। আর কেউ না জানুক, ইমামসাহেব ঠিকই জানবেন হামলাকারী কারা, কী তাদের উদ্দেশ্য। পৌছনো মাত্র দ্বিতীয় বোমা ফাটে, শেষ হয়ে যায় ওরা তিনজনই। 

মাইক রেখে বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয় তেজো। ওর মা যে এতক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদছিলেন, ওরা বুঝতে পারে। দরজায় দাঁড়িয়েই মুসা ইন্টার্ভিউ দেওয়ার মতো বলে যান কথাগুলো...... বাগদাদের পতনের পর ওঁর ছেলের চাকরি ছিল না। সাদ্দামের বাথ পার্টির সক্রিয় কর্মী আরও অনেকের মতই নিঃস্ব হয়ে যায় ওরা। দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে যৎসামান্য মূলধন নিয়ে ওষুধ আমদানির ব্যাবসা খুলেছিল ওঁর ছেলে। পোলিও-র ইঞ্জেকশান বেচত বলে বাড়ি বয়ে শাসিয়ে গিয়েছিল কট্টরপন্থীরা। মুসলমান বাচ্চাদের শরীরে ছুঁচ দিয়ে পশ্চিমি বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছিল আল-ফাতসি শহরে। ওদের নিষেধাজ্ঞা মানেনি ওনার ছেলে, তারই পরিণাম সুইসাইড বোমা। 

বুটের আওয়াজে সম্বিত ফিরে পায় তেজো। মেরিনরা এসে পড়েছে মুসার পাড়ায়, টেররিস্ট ধরতে ঘরে ঘরে সার্চ চালাচ্ছে। 

“অন্তত এই বাড়িটা বাদ দিতে বলো ওদের,” চাপা গলায় চার্লিকে বলে তেজো। “এখনও মৃতদেহের সৎকার বাকি, প্রিয়জনের সদ্য বিয়োগের পর আরেকটা জুলুম কী করে সামলাবে এরা?”  

“তুমিই বলে দেখো, শুনলে তোমার কথাই শুনবে,” হাল ছেড়ে ক্যামেরা কোলে বসে পড়ে চার্লি। 

লাথির তোড়ে পাশাপাশি দরজাগুলো ভেঙে পড়ছিল। আপত্তি করলেই ঘুসি, রাইফেলের বাড়ি। বাড়ির কুকুর ফালতু চেল্লামিল্লি করলে এক শটে খেল খতম। বারো থেকে ষাট বয়সী পুরুষদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় লাইন করে মাথার ওপর হাত তুলিয়ে জেরা করছিল আরবি ভাষী এক লেফটানেন্ট। প্রশ্নর মানে বুঝতে না পেরে ফেল করা ছাত্রর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকেই। সাধারণ ইরাকিদের মধ্যে মাথায় হেলমেট আর মুখে গ্যাস মাস্ক পরা মেরিনদের দেখে মনে হচ্ছিল এরা বুঝি অন্য গ্রহের প্রাণী। 

দাপাদাপি করে ঘরে ঢুকেই সটান আলমারির দরজা ধরে টান মারে সোলজাররা। কাপড়জামা, লেপ-কম্বল-বালিশ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বন্দুকের নল তাক করে গৃহস্বামীর মাথায়। উনিও তখন পরিবারের বাকিদের সঙ্গে মেঝের ওপর মাথায় হাত তুলে বসেছেন, বাচ্চাগুলো জড়াজড়ি করে আছে একে ওপরকে। কিচেন থেকে বাসনের ঝনঝন শোনা যেতেই, ছোট মেয়েটিকে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায় তেজো। ওদের মধ্যে সার্জেন্ট গোছের লোকটাকে উদ্দেশ্য করে ঝাঁঝিয়ে ওঠে। 

“কী হচ্ছে কী! এভাবে মিছিমিছি হয়রানি করার কী মানে?”

গোলাপি চাদরে মাথা ঢাকা তেজোর মুখে ঝরঝরে ইংরেজি শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে যায় সার্জেন্ট। ভেতরের কামরা থেকে বেরিয়ে এসে মেরিনরা ওকে ঘিরে দাঁড়ায়। সুযোগ পেয়ে বলেই যায় তেজো।  

 “আজই প্রিয়জনকে হারিয়েছে এরা। দেখছ না, বাচ্চাগুলোর কী অবস্থা? কী দোষ করেছে এরা? দুদণ্ড শান্তিও কী এদের প্রাপ্য নয়?”

“কে তুমি?” তেজোকে খুঁটিয়ে দেখে সার্জেন্ট। “ইংরেজি শিখলে কোত্থেকে?”

মেরিনদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। ঢ্যাঙা গোছের এক ছেলে সার্জেন্টকে মনে করিয়ে দেয় আল-ফাতসিতে ভিনদেশি জেহাদিরা জড়ো হয়েছে বলে খবর। যাদের মধ্যে মেয়ে টেররিস্ট থাকাও আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। 

আবার হুমকি দেয় সার্জেন্ট, “চট করে বলে ফেলো কোন দেশ থেকে এসেছ, এখানে কী দরকার, তোমার সাগরেদরা কোথায়।”

ছোট্ট ঘরটা ঘামের উৎকট গন্ধে ভরে গেছে, বুটজুতোর ধুলো কাদায় আস্তাবলের মতোই দুরবস্থা। কান্না আটকে রাখতে না পেরে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে ছোটরা। 

“পাসপোর্ট দেখাও।” এবার রীতিমত গর্জন, বেয়নেটের নল কাঁধ, বুক, পেটের ওপর। তেজোর হয়ে মুখ খোলে চার্লি। 

“ও এসেছে নিউ ইয়র্ক থেকে, আমি মিসিসিপি। তোমরা কোত্থেকে এসেছ? সার্জেন্টের কথা শুনে মনে হচ্ছে উনি আমাদের কমান্ডার লুকের মতোই টেক্সান, তাই না?”

“লুক!” থমকে, মুখচাওয়াচায়ি শুরু হয় এক প্রস্ত। “কে লুক, কোথায় সে?” 

“আরে, আমাদের আলফা কম্পানির কমান্ডার লুককে চেনো না! উনিই তো আমাদের সব্বাইকে দোহা থেকে উড়িয়ে নিয়ে এলেন এই ইরাকে।” মশকরা করে চার্লি।  

এবার নিজের প্রেস কার্ডটা সার্জেন্টের নাকের ডগায় তুলে ধরে তেজো। ঠাণ্ডা গলায় ফের আর্জি জানায় মেরিনদের, “এই পরিবারটিকে অন্তত খানাতল্লাশির হাত থেকে ছাড় দেওয়া উচিত। দেখছই তো এরা নাবালক, প্রাপ্তবয়স্ক বলতে এক বৃদ্ধ আর এক সদ্য বিধবা।”

“আরে! এই তো সকাল সকাল ব্র্যাডলি চড়ে আমাদের সঙ্গে এখানে এলো!” এতক্ষণে তেজোকে চিনে ফেলে একজন। “সারা রাস্তা একটা ইরাকির সঙ্গে ভ্যাজর ভ্যাজর করছিল।”

“তুমি যে রিপোর্টার সেটা আগে বলনি কেন?” সার্জেন্টকে কিছুটা অপ্রতিভ শোনায়। 

“কী করে বলব? এঁদের অনুমতি নিয়ে এখানে ঢুকেছিলে তোমরা? কথা বলবার সুযোগ দিলে তো বলব!” 

“পারমিশান নেব এদের কাছে!” হোহো করে হেসে ওঠে মেরিন সার্জেন্ট। “চোদ্দপুরুষের বাপের ভাগ্যি এখনও সব ক’টাকে উড়িয়ে দিইনি। আরও একজন সুইসাইড বমবার লুকিয়ে আছে এই বাড়িগুলোর ভেতর, এরাই কেউ আশ্রয় দিয়েছে ব্যাটাকে।” 

“ইরাকি বলেই টেররিস্ট? এই বাচ্চাদের বাবাই মারা পড়েছে আজ সকালে। নিজেই নিজেকে মেরেছে নাকি!” 

তেজোর প্রশ্ন এড়িয়ে এবার ধমকে ওঠে সার্জেন্ট, “কে তোমাদের এখানে এনেছে? ইরাকিদের বাড়ি ঢুকতে গেলে আমাদের পারমিশান লাগবে জানো না?” 

“তোমাদের পারমিশান লাগবে কেন?” কোমর বেঁধে ঝগড়া করে তেজো?

“লাগবেই তো। আমাদের দয়ায় বেঁচে আছো, নইলে সুইসাইড বোমায় কবে উড়ে যেতে।” 

“চলো, এবার যাই...” তেজোকে তাড়া দেয় চার্লি। ওর চোখেমুখে উদ্বেগ। কথাকাটাকাটির মধ্যে আমের ফিরে এলে নির্ঘাত ওকে বমবার বলে পিছমোড়া করে নিয়ে যাবে মেরিনরা। চার্লির হাত ছাড়িয়ে প্রত্যুত্তর দিতে যায় তেজো, তখনই ওর কানে তালা ধরিয়ে সার্জেন্টের চিৎকার... “বেরও......!” 

“একি তোমরা এখনও এখানে! আসল খবরটাই মিস করে যাবে যে!”

বাজার আর মসজিদ পেছনে ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে সাংবাদিকের দল, ছুটতে ছুটতেই তেজো আর চার্লির উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়ে ক্যামেরাম্যান জন। আমের কোথায়? উৎকণ্ঠায় কিংকর্তব্যবিমুড় ওরা দু’জনই। তৃতীয় সুইসাইড বমবার সন্দেহে ধরা পড়েনি তো? হয়তো জিজ্ঞাসাবাদের পর্ব শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, হাতে পায়ে সেকল, চোখে কালো কাপড়ের ঠুলি, চামড়ায় চাবুকের দাগ। 

“আসল খবরটা কী বলুন তো?” ফুটপাতের ওপর ইট পেতে বসে আছে এমন একজনকে প্রশ্ন করে তেজো। দেখে মনে হয় লোকটি উচ্চশিক্ষিত, চোখে পুরু চশমা, কাঁধে এক ব্যাগ বই।

“খবর মানে লুঠ,” ধিরস্থির জবাব। “সারা সকাল মৃতদেহ ঘেঁটে ক্লান্ত সবাই, এখন একটু ফুর্তির পালা। এই তো, আমাকেই দেখো,” ব্যাগ খুলে গোটা তিনেক বই বার করে দেখান ভদ্রলোক। “দুশো ছাব্বিশ বছর পুরনো মহম্মদ আব্দুল রহমান আল-কুনিরলির হাতে লেখা কোরান। পৃষ্ঠাগুলো কেমন সুন্দর সোনার জলে কাজ করা দেখেছ! এই হল মক্কার মালিক শারিফ হুসেনের ডাইরি, এই তাঁর বাৎসরিক ফরমাইসের লিস্ট, যার মধ্যে বাবিলনের আতর, মসুলের উট, নাজাফের খাস্তাউই খেজুর থাকবেই থাকবে। ডাইরির বদলে কবিতা চাইলে কবিতা পাবে,” পরম যত্নে আরেকটা বইয়ের ঝুরঝুরে পাতা ওলটান উনি, “দিভান-ই-হাফিজ!” 

“কোথায় পেলেন এগুলো?” 

“কোথায় আবার?” চার্লির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত হাসি হাসলেন ভদ্রলোক, “এক কালে আল-ফাতসির লাইব্রেরির সুনাম ছিল। পুরনো বই সংগ্রহ করার বাতিক ছিল এখানকার গভার্নারের। কখনও বাগদাদ কখনও মসুলের ইউনিভার্সিটি থেকে পটিয়েপাটিয়ে বই নিয়ে আসতেন। ফেরত দেবার ধার ধারতেন না! সেই লাইব্রেরিটাই আজ পোড়ানো হল। আগেভাগে খবর পেয়ে চুরি করে আনলাম এই ক’খানি।”

“লাইব্রেরি পোড়ানো হল কেন, এতে কার কী লাভ?” অবিশ্বাস্য লাগে তেজোর।

“লাভ!” এবার বেশ গুরুগম্ভীর শোনায় লোকটিকে। “রাগ হলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে মানুষ। সেটাই আমাদের স্বভাব। আগেও ঘটেছে এই ঘটনা।” 

“আর কোথায়, কোন শহরে?” 

“যেমন ধরা যাক ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, স্বয়ং চেংগিস খাঁ-র নাতি যখন বাগদাদ জয় করে নেন। শহরের সমস্ত বই একত্র করে টাইগ্রিস নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আরেবিয়ার দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, কাব্য - যাকে বলে ঝেটিয়ে বিদায়! শোনা যায়, বইয়ের কালিতে নদীর জল কালো হয়ে গিয়েছিল সেদিন।”     

আল-ফাতসিতে মেরিনদের আগমনের পর লুঠতরাজ শুরু হতে সময় লাগেনি। শোরুমের কাঁচ ভেঙে ফ্রিজ, টিভি, মেয়েদের অন্তর্বাস, বাচ্চাদের খেলনা। ফার্নিচারের দোকান ফাঁকা, এক গাড়ি আসবাব নিয়ে ওদের সামনে দিয়েই হুস করে বেরিয়ে গেল মাঝবয়সি একজন। চার্লি সমেত অন্য ক্যামেরাম্যানদের অনুরোধে মাথার টুপি খুলে ছবি তুলিয়ে গেল হাসিমুখেই।

“ওর নাম সুলেমান।” বই ঘাড়ে তেজোকে লুঠেরাদের একে একে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন স্বল্পভাষী, অমায়িক সেই ভদ্রলোক। সবাই এই এলাকারই বাসিন্দা, ধর্মভীরু, সজ্জন মানুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দোকানদাররা এদের পূর্বপরিচিত, আত্মীয়-বন্ধুর পর্যায়ও পড়ে কেউ কেউ। 

“আগামী মাসে সুলেমানের মেয়ের বিয়ে। তাই যৌতুকের গোটাকতক ফার্নিচার নিয়ে গেল।” 

ব্যাংকের সামনেই ভিড় বেশি। বস্তা ঘাড়ে টাকার বান্ডিল নিয়ে যাচ্ছে, ১০০ দিনারের নোটের ওপরই নজর সবার। পাঁচ-দশ দিনার পেলে হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে, ছেঁড়া তুলোর মতো হাওয়ায় ভাসছে সেগুলো। 

“লোকগুলো বোকা!” নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন ভদ্রলোক। “দিনার নিয়ে কী হবে? দোকানবাজার ফাঁকা, কেনবার মতো কী-ই বা পড়ে আছে এ পোড়া শহরে!”

চার্লিকে একা পেয়ে বছর আটেকের এক বাচ্চা ঘ্যানঘ্যান করছিল। হাতের মুঠো খুলে কী জানি কী দেখিয়ে দু’হাতের আঙুল দিয়ে দরকষাকষি।

“বড়দের চেয়ে এরাই বেশি বুদ্ধিমান। হাতাতে পারলে এমন জিনিশ হাতাও যা বিদেশিরা কিনতে চাইবে, বিদেশি মানে সোলজার বা রিপোর্টার। ইরাকের সুভেনির বেচে ডলার কামানো আজকের দিনে সবচেয়ে ভাল ব্যাবসা।” 

“কী সুভেনির?”

“যেমন ধরা যাক, প্রাচীন অ্যাসেরিয়ান মূর্তি, সোনার কয়েন বা দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি। অপেক্ষায় রয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার ডিলাররা, পেলেই পাচার করে দেবে প্যারিসের লুভ বা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। যুদ্ধের সুভেনিরেরও ডিমান্ড আছে। মৃত ইরাকি জেনেরালের ইউনিফরম থেকে খুলে নেওয়া মেডেল, বা সাদ্দামের ছবিওয়ালা পোস্টার, এমনকি আগুনে ঝলসানো সুইসাইড ভেস্ট।” 

এক নিমেষে ওদের ঘিরে ফেলেছে বাচ্চার দল, সুভেনিরগুলো হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে দুই দিনার থেকে শুরু করে দশ পর্যন্ত দাম হেঁকে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। কিনবে না বললে কী হবে, তেজোর হাত ধরে রীতিমত টানাটানি। 

“বলছি না কিচ্ছু কিনব না, সুভেনির দরকার নেই আমার।” 

“কেন কিনবে না, সব্বাই তো কেনে।” 

“এই দেখো মর্গ থেকে পাওয়া আংটি!” দিনের পড়ন্ত আলোয় দামি পাথরটা ঝলসে ওঠে। 

“ফ্ল্যাগ চাই ফ্ল্যাগ?” অনেকেরই হাতে সাদ্দামের বাথ পার্টি বা ইরাকের জাতীয় পতাকা। 

চার্লিকে ডাকাডাকি করে তেজো, দেরি হলে হয়তো ওদের এখানে ফেলেই ফিরে যাবেন কমান্ডার লুক। ধারেকাছে মেরিন বা সাংবাদিক কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। এতক্ষণ ওদের সঙ্গে কাটিয়ে বই-প্রেমি লোকটিও চলে গেছেন নিজের ডেরায়, রাস্তাঘাটও সুনসান।

জরাজীর্ণ আলখাল্লা পরা একরত্তি এক ছেলে সবাইকে ঠেলেঠুলে তেজোর কোলের কাছে সিঁধিয়ে আসে। হাতে ফাঁকা মর্টারের খোল, ভেতরে টলটল করছে কী একটা জলীয় জিনিশ। তেজোর মুখের কাছে তুলে ধরে।

“কী এটা?”   

“মাথার ঘিলু।” 

“কী!” 

খিলখিল  করে হাসে ছেলেটা। “আমেরিকান ঘিলু! গত সপ্তাহে মসুলে সুইসাইড বোমায় মরেছিল যে মেরিনটা, তারই। আমার দাদা মাথার খুলি ফাটিয়ে বার করেছে। নেবে?”

হটাৎ উদয় হয়ে তেজোকে ভিড় থেকে টেনে বের করে আনে আমের। তারপর তিনজনে মিলে দৌড়।  

আল-ফাতসি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে আলফা কম্পানি, একেবারে শেষের ব্র্যাডলিতে তেজো, আমের আর চার্লি। দিনের আলো ফুরিয়ে মরুভূমি ততক্ষণে অকুল সমুদ্র। ঝট করে ঠাণ্ডা পড়ে যাওয়ায় ভেস্টের জিপ তুলে দেয় তেজো। জানলার কাঁচ সরিয়ে মেরিনদের দেখাদিখি সিগারেট ফুঁকছিল চার্লি। 

“কোথায় ভ্যানিশ হয়েছিলে বলত? খুঁজে না পেয়ে ভয় হচ্ছিল মেরিনরা বুঝি ধরে নিয়ে গেছে তোমাকে।” আমেরকে বকে তেজো। 

না বলে অন্তর্ধান করেছিল তাই আমেরকে যথেষ্ট অনুতপ্ত মনে হয়। এবং কিছুটা বিচলিত। 

“ধরেই নিয়ে গিয়েছিল।” 

“সেকি! কেন?” চমকে ওঠে তেজো। “তুমি যে আমাদের সঙ্গে এসেছ, তা জেনেও?”

মাথা নাড়ে আমের। “আরবি ভাষা জানে এমন একজনকে ওদের প্রয়োজন ছিল। মানে কমান্ডার লুকের। জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন অসুবিধে হচ্ছিল। বন্দির ভাষায় এখানকার আঞ্চলিক টান, তাই উত্তরগুলো বুঝে উঠতে পারছিলেন না আরবি জানা মেরিন অফিসার।”

“কে সেই বন্দি?” পাক্কা রিপোর্টারের কায়দায় প্রশ্ন করে তেজো।

উত্তরের আগে ঢোঁক গেলে আমের, “আল-ফাতসির ইমাম।” 

“মানে যে মসজিদে বোমা পড়েছিল, তারই...?”

“হু।” 

সারাদিন পর এই প্রথম আসল খবরের গন্ধ পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে তেজো, “কেন, ইমাম কেন? কী দোষ ওনার?”

“ইমামই তৃতীয় সুইসাইড বমবারকে লুকিয়ে রেখেছে, কমান্ডার তাই সন্দেহ করেছিলেন। ওকে প্রশ্ন করলেই সব জানা যাবে।”

“প্রশ্ন মানে টর্চার, তাই তো?” 

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে আমের, তারপর নিচু গলায় বলে, “টর্চারের প্রয়োজন হয়নি। তার আগেই সব কবুল করে নিয়েছেন ইমামসাহেব।” 

“কী স্বীকার করেছেন?” 

“উনি সবই জানতেন। সপ্তাহ দুয়েক আগেই টেররিস্টরা আল-ফাতসিতে এসে ওঁকে সব জানিয়ে যায়। শাসিয়ে গিয়েছিল খবরটা আগেভাগে ফাঁস হয়ে গেলে ওঁরই মুণ্ডু কাটা যাবে। গতকাল রাত্তিরে মসজিদেই রাত কাটিয়েছিল ইয়েমেন থেকে জিহাদ লড়তে আসা তিনটি ছেলে। কিন্তু ওরা কথামত কাজ হাসিল করতে পারেনি।” 

“পারেনি কেন?” 

“বাজারের পর দ্বিতীয় বোমাটা জেলার সদর দপ্তরে ফাটাবার কথা ছিল, ভুল বসত যেটা মসজিদের ভেতরই ফেটে যায়। নার্ভ ফেল করায় তৃতীয়জন আর বাইরে পা বাড়ায়নি।”

বেশ খানিকটা রাস্তা চুপ করে ছিল তেজো। এত বড় একটা খবর এত কাছাকাছি ঘটে গেল, অথচ কমান্ডার ওদের কাউকে জানতেই দিলেন না! এটা ওয়ার রিপোর্টিং না ছ্যাবলামি! আল-ফাতসি নিয়ে কী স্টোরি করবে ও? হতাহতের সংখ্যা ঘোষণা করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবে? নাকি মুসার হতভাগ্য পরিবারের কিসসা শুনিয়ে দর্শকের সহানুভূতি কুড়বে? এসব এখানে জলভাত, ইরাকি ট্র্যাজেডি এখন গ্রীক ট্র্যাজেডিরও ঊর্ধ্বে - বহুল ব্যবহারে নীরস, ক্লান্তিকর। বড়জোর সুভেনিরের ঝালমুড়ি খাইয়ে রিপোর্টের চাহিদা পুষিয়ে দেওয়া, এই যা।

নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল আমের। এ রাস্তা চেনা নয়, কেন এই পথে এলেন কমান্ডার লুক? সারাদিন এনকাউন্টার সামলে ক্যাম্পে ফেরার তাড়া আছে বলেই কি? ব্র্যাডলি আর ট্যাংকের কনভয় হুহু করে এগোলেও, এই অঞ্চলটা এখনও মেরিনদের পক্ষে সুরক্ষিত নয়, এখনও শত্রুর হাতে আশেপাশের বেশ কিছু গ্রাম। চার্লি বা তেজো কেউই এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি, নিরাপত্তার ব্যাপারটা মেরিনদের ওপর ছেড়েই পথটুকু পার করার অপেক্ষায় বসে ছিল। 

ব্র্যাডলি থেমে গেলে ওয়াকি-টকিতে খবর আসে। সামনে এক পাল ভেড়া, তাই কয়েক মিনিটের বিরতি। ওরা পাস কাটিয়ে গেলেই আবার ছুটবে কনভয়। ভারি বুটের আওয়াজে বোঝা গেল বালির ওপর পায়চারি করে রক্তচলাচল বাড়িয়ে নিচ্ছে মেরিনরা, কোরাসে গানও গাইছে গলা ছেড়ে... 

আই অ্যাম আ মেরিন অন দ্য বীচ

আই অ্যাম আ কিলিং মেশিন 

আই অ্যাম আ ডেভিল ডগ, আই অ্যাম মারচিং অন

আই অ্যাম আ ওয়ারিয়ার

এন্ড দিস ইস মাই সং

            বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনে তেজো বুঝেছিল ওগুলো ল্যান্ডমাইন, যার লক্ষ্য ওরাই - মানে আলফা কম্পানির মেরিন কোর।

Write a comment ...